কয়রার মানুষের সময় কাটছে বাঁধে

বাঁধ নির্মাণের কাজ চলছে (ছবি ইন্টারনেট থেকে নেওয়া)প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আম্পনের কবলে পড়ে বিধ্বস্ত হওয়া খুলনার কয়রা উপজেলার মানুষের সময় কাটছে এখন বাঁধে। খেয়ে না খেয়ে কষ্টের মধ্যে থেকেও তারা দিন পার করছেন ভাঙনকবলিত বাঁধ মেরামতে। সকাল হলেই ছুটছেন বাঁধ মেরামত কাজে। আর রাত কাটাতে হচ্ছে রাস্তার ধারে তৈরি মাচার ওপর।

উপজেলা জুড়েই নিত্য পণ্য কেনাকাটায়ও সংকট দেখা দিয়েছে। করোনা আতঙ্কের মধ্যে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাবে কয়রার মানুষ এখন দিশেহারা। উপজেলার ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় সব এলাকার বাঁধ আটকানো সম্ভব হলেও ৪টি স্থানে বাঁধ আটকানোর কাজ এখনও চলছে। এগুলো হচ্ছে উত্তর বেদকাশির হাজতখালী, গাববুনিয়া ও গাজীপাড়া এবং কয়রা সদর ইউনিয়নের ঘাটাখালী।

উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের গাজীপাড়া এলাকার আজিজুর রহমান বলেন, ‘রাতে থাকার মতো কোনও শুকনো জায়গা নেই। সারাদিন বাঁধে কাজ করে সময় কাটে। দূরের এক আত্মীয়ের বাড়িতে চলে সকালের রান্না। সেখানে গিয়ে খেয়ে রাস্তার ওপর মাচা করে ঘুমিয়ে থাকি।'

কয়রা উপজেলার সদর ইউনিয়নের ২ নম্বর কয়রা গ্রামের রাবেয়া খাতুন বলেন, 'দিনে দুই বার পানিতে তলিয়ে যাচ্ছি। জোয়ারে ডুবে যায় ঘর, ভাটায় জেগে ওঠে। এ অবস্থার মধ্যেই বেঁচে আছি। নতুন করে বাঁধ নির্মাণ কবে হবে, আমরা কবে নাগাদ নির্বিঘ্নে নিজেদের ঘরে থাকতে পারবো জানি না।'

দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের বাসিন্দা আবু সাইদ বলেন, 'উত্তর বেদকাশী ও দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়ন বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গৃহহীন হয়ে পড়েছেন এ এলাকার মানুষ। চারিদিকেই শুধু থৈ থৈ পানি। ঘরে খাবার নেই। মাথা গোজার ঠাঁই নেই। খোলা আকাশের নিচে রাত যাপন করছি। আবার কেউ রাস্তা বা বাঁধের ওপর অস্থায়ী ঘর তুলে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছেন। এ অবস্থার মধ্য দিয়েই মানুষ পার করছে দিন।'

সদর ইউনিয়নের বাসিন্দা আল আমিন বলেন, 'এখন পর্যন্ত অধিকাংশ মানুষ খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছে। কেউ কোনও ধরনের সহযাগিতা করেনি। পুরুষরা সকাল হলেই যাচ্ছে বাঁধ বাঁধতে। নারীরা ধার দেনা করে চাল ফুটিয়ে রাখছে। তাই লবণ পানি দিয়ে খাচ্ছে মানুষ। ইউনিয়নে ৫২শ’ পরিবার রয়েছে। সরকারি সাহায্য এসেছে ২৫০ পরিবারের জন্য। আমার ওয়ার্ডে ৫১৭টি পরিবার রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ২০টি পরিবারকে সরকারি ত্রাণ দেওয়া সম্ভব হয়েছে।'

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা যায়, কয়রায় পাউবোর ১৩ ও ১৪-১ নম্বর পোল্ডারের অন্তত ৪০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ উপজেলার প্রায় আড়াই লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আম্পানের আঘাতে কয়রার পাঁচটি ইউনিয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রায় পাঁচ হাজার হেক্টর জমির ফসল লবণ পানিতে প্লাবিত হয়েছে। বাঁধ ভেঙে জোয়ারের পানিতে ছোট বড় পাঁচ হাজার মাছের ঘের ভেসে গেছে।’

কয়রা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এস এম শফিকুল ইসলাম বলেন, 'স্থানীয়রা স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে আপাতত বাঁধগুলো মেরামতের মাধ্যমে নদীর জোয়ারের পানি প্রবেশ ঠেকানোর কাজ করছেন। আর চারটি পয়েন্টের কাজ শেষে হলেই পানি ওঠা বন্ধ হবে।'

পানি উন্নয়ন বোর্ড কয়রার এসও মশিউল আবেদিন বলেন, 'কয়রার মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমেই বাঁধগুলো আটকানোর কাজ করছেন। পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে তাদের প্রয়োজনীয় বস্তা, সুতলি সরবরাহ করা হচ্ছে। এ কাজে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও ব্যক্তিভাবে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করছেন।'

কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শিমুল কুমার সাহা বলেন, 'স্থানীয় লোকজনের সার্বিক সহযোগিতা ও স্বেচ্ছাশ্রমের ফলে অধিকাংশ বাঁধ আটকানো হয়েছে। হাজতখালী, গাজীপাড়াসহ ৩-৪টি স্থানে বাঁধ আটকানোর কাজ চলছে।' তিনি বলেন, 'সেনাবাহিনীর সদস্যরা কয়রায় অবস্থান নিয়ে বাঁধ নিয়ে পর্যালোচনা করছেন। তারা স্থায়ীভাবে বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা করছেন।'