জীবন-মরণ যুদ্ধে ১৭ ডিসেম্বর খুলনায় আত্মসমর্পণে বাধ্য হয় হানাদার বাহিনী

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করলেও খুলনা শত্রুমুক্ত হয়নি। একদিকে ঢাকায় আত্মসমর্পণ করেছিল হানাদার বাহিনী, অপরদিকে খুলনায় জীবন-মরণ যুদ্ধ করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। ১৩ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া এই সম্মুখযুদ্ধ ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত আঘাতে পরিণত হয়। ফলে ১৭ ডিসেম্বর ভোরে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করলে শত্রুমুক্ত হয় খুলনা। মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে লড়াই করে খুলনা শহর দখলমুক্ত করেন। এদিন খুলনায় বিজয়ের পতাকা ওড়ে।

সেদিন বিজয় দেখা বীর মুক্তিযোদ্ধা কামরুজ্জামান টুকু বলেন, ১৬ ডিসেম্বর সারাদেশে বিজয় উৎসব হলেও খুলনায় আমরা জীবন-মরণ যুদ্ধ করেছি। ১৩ ডিসেম্বর খুলনার শিরোমনিতে শুরু হওয়া সম্মুখযুদ্ধ ১৭ ডিসেম্বর ভোরে পাক সৈন্যদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। এই যুদ্ধ ব্যাটল অব শিরোমনি নামে পরিচিত। এর মধ্য দিয়ে ১৭ ডিসেম্বর খুলনা মুক্ত হয়। ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের দিনে মুক্তিবাহিনীকে খুলনায় কঠিন যুদ্ধ করতে হয়েছে।

মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, চূড়ান্ত বিজয়ের আগে ১৯৭১ সালের শেষ দিকে দক্ষিণাঞ্চলের শ্যামনগর, দেবহাটা, সাতক্ষীরা হানাদারমুক্ত হওয়ার পর দক্ষিণাঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা বেড়ে যায়। তখন তাদের একটাই লক্ষ্য খুলনাকে মুক্ত করা। কপিলমুনির ভয়াবহ যুদ্ধের পর দক্ষিণাঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর সামনে আর কোনও বাধা না থাকায় মুক্তিযোদ্ধারা একটি লঞ্চে রওনা দিয়ে বারআড়িয়া-মাইলমারা হয়ে বটিয়াঘাটায় আসেন এবং জলমা-চক্রাখালি হাইস্কুল ভবনকে ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করেন।

১০ ডিসেম্বর সকালে লঞ্চে বসে মেজর জয়নুল আবেদীন খান, গাজী রহমত উল্লাহ দাদু, শেখ কামরুজ্জামান টুকু, মীর্জা খয়বার হোসেন, লে. আরেফিন, শেখ ইউনুস আলী ইনু, স ম বাবর আলী, সাহিদুর রহমান কুটু, শেখ আব্দুল কাইয়ুম প্রমুখ খুলনা শহর শত্রুমুক্ত করার মূল পরিকল্পনা করেন। সেসময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গল্লামারী রেডিও স্টেশন, খুলনা লায়ন্স স্কুল, পিএমজি কলোনি, শিপইয়ার্ড, ৭ নম্বর ঘাটের জেটি, টুটপাড়া, বয়রা ফায়ার ব্রিগেড স্টেশন, ওয়াপদা ভবন, খালিশপুরের গোয়ালপাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্র, গোয়ালখালী ও দৌলতপুরের কয়েকটি স্থানে অবস্থান করছিল। তখন সিদ্ধান্ত হয়, মুক্তিযোদ্ধারা চারদিক থেকে খুলনা শহরে প্রবেশ করবেন। কোনও বাধা এলে তা সশস্ত্রভাবে প্রতিহত করবেন। ফাহিম উদ্দিন ও লে. নোমান উল্লাহর নেতৃত্বে তার বাহিনী সেনের বাজার, রাজাপুর ও রূপসা ঘাটের দিক থেকে, বোরহান উদ্দিন ও তার বাহিনী ক্রিসেন্ট জুটমিল ও এর পাশে নৌঘাঁটিতে, মুজাহিদ ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাস্টার ও তার বাহিনী কুলুটিয়া নামক স্থানে অবস্থান নিয়ে খুলনা রেডিও স্টেশনে, আফজাল ও কুতুব উদ্দিন তাদের বাহিনী নিয়ে ঝড়ডাঙ্গা ও সাচিবুনিয়ার দিক থেকে পাক সেনাদের লায়ন্স স্কুলের ঘাঁটিতে আক্রমণ চালিয়ে খুলনা শহরের দিকে প্রবেশ করেন।

এরপর মুক্তিযোদ্ধারা বেতারে শুনতে পান, মিত্র বাহিনীর কমান্ডার মানেক শ’র আহ্বানে সাড়া দিয়ে পাকিস্তানি সেনারা ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে আত্মসমর্পণ করছে। কিন্তু খুলনায় তারা আত্মসমর্পণে রাজি হচ্ছিল না। এই সংবাদ পাওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধারা খুলনা শহরের দিকে এগিয়ে যান। ১৬ ডিসেম্বর যখন ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে সেদিন খুলনা শহর ও এর আশপাশে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিচ্ছিন্নভাবে যুদ্ধ চলছিল। সড়কপথে যশোর রোড ধরে খুলনায় আসার পথে শিরোমনিতে মিত্রবাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে উভয় পক্ষের ব্যাপক সংখ্যক লোক হতাহত হয়। ১৭ ডিসেম্বর ভোরে শিপইয়ার্ডের কাছে রূপসা নদীতে বটিয়াঘাটা ক্যাম্প থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি লঞ্চ এসে পৌঁছে। কিন্তু শিপইয়ার্ডের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা পাক সৈন্যরা লঞ্চটির ওপর আক্রমণ চালায় এবং গুলিবর্ষণ করে। মুক্তিবাহিনীও লঞ্চ থেকে নেমে শিপইয়ার্ডের ওপারের ধানক্ষেতে অবস্থান নিয়ে পাল্টা গুলি চালান। 

অবশেষে সব বাধা অতিক্রম করে ১৭ ডিসেম্বর সকালে মুক্তিযোদ্ধারা খুলনা শহরে প্রবেশ করতে শুরু করেন। খুলনা সার্কিট হাউস দখল করার পর মেজর জয়নুল আবেদীন ও রহমত উল্লাহ দাদু যৌথভাবে সার্কিট হাউসে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। মুক্তিযোদ্ধা স ম বাবর আলী, আবুল কালাম আজাদ, রেজাউল করিম, গাজী রফিকুল ইসলাম প্রমুখ হাদিস পার্কে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। মিত্রবাহিনী খুলনা শহরে প্রবেশ করার আট ঘণ্টা আগেই হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এরপর খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলের দফতর থেকে ব্রিগেডিয়ার হায়াত খুলনা সার্কিট হাউস ময়দানের দিকে রওনা হন।

পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজিত ও বিধ্বস্ত সৈন্যরাও সার্কিট হাউস ময়দানের দিকে রওনা হয়। রাস্তায় তখন হাজারো মানুষের ঢল নামে। সবার মুখে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি। সবাই ছুটেন খুলনা সার্কিট হাউস ময়দানের দিকে। ১৭ ডিসেম্বর সার্কিট হাউস ময়দানে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণের পর সেখানে উপস্থিত হাজার হাজার মানুষ প্রাণভরে গ্রহণ করেন স্বাধীন বাংলার মুক্ত বাতাস।

বৃহত্তর খুলনা জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বইয়ের লেখকের গৌরাঙ্গ নন্দী তার বইতে উল্লেখ করেছেন, ১৬ ডিসেম্বর রাজধানীতে হানাদার বাহিনীর সর্বাধিনায়ক আত্মসমর্পণ করলেও খুলনায় আত্মসমর্পণে রাজি হয়নি। ফলে ১৬ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর সম্মিলিত দল পাকিস্তানি সেনাদের সর্বশেষ অবস্থানগুলোর ওপর আবারও গোলাবর্ষণ শুরু করে। অবশেষে পাক সেনারা ১৭ ডিসেম্বর সকালে আত্মসমর্পণে রাজি হয়। মুক্তিযোদ্ধা আলকাছ, রেজওয়ানসহ আরও অনেকের কাছে তারা তাদের স্টার ও ব্যাজ খুলে দেয়।