যশোরের নরেন্দ্রপুর এখন ‘ব্যাটের গ্রাম’

দেশে এ মুহূর্তে সবচাইতে জনপ্রিয় খেলার নাম ‘ক্রিকেট’। আন্তর্জাতিক খেলাগুলোতে আমাদের ক্রিকেটাররা অনেক সুনাম বয়ে আনায় এ খেলা এখন ছড়িয়ে পড়েছে সারা বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জেও। তাই সব এলাকাতেই দেদারসে বিক্রি হচ্ছে ক্রিকেটের সরঞ্জাম। একসময় ক্রিকেটের সব ধরনের সরঞ্জামই আনা হতো বিদেশ থেকে। তবে সময় বদলেছে। উন্নতমানের সরঞ্জাম এখনও বিদেশ থেকেই আনতে হয়, তবে সাধারণমানের সরঞ্জামের অনেক কিছুই এখন দেশে তৈরি হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ক্রিকেট ব্যাট। দেশজুড়ে ক্রিকেট ব্যাটের অন্যতম যোগানদাতা এখন যশোরের নরেন্দ্রপুর এলাকা। এই গ্রামে দেশীয় প্রযুক্তিতে এখন এতোই বেশি ক্রিকেট ব্যাট তৈরি ও বিপণন হচ্ছে যে স্থানীয়রা এখন নরেন্দ্রপুর গ্রামকে চেনে ‘ব্যাটের গ্রাম’ নামে।     এ এলাকার অনেকেই এখন ক্রিকেট ব্যাট তৈরি করে পাল্টে ফেলেছেন নিজেদের ভাগ্য।

যশোর শহর থেকে প্রায় ১৯ কিলোমিটার দূরে নরেন্দ্রপুর গ্রাম।এই গ্রামের মিস্ত্রিপাড়াই মূলত ‘ব্যাটের গ্রাম’ হিসেবে বিশেষ পরিচিত। আর এই গ্রামের বাসিন্দা সঞ্জিত মজুমদারের হাত ধরেই তৈরি হয়েছে এই রূপকথা।

ব্যাটের কারিগর সঞ্জিৎ মজুদমারকে খুঁজতে বাংলা ট্রিবিউনের পক্ষ থেকে সরেজমিনে যাই নরেন্দ্রপুর গ্রামে। একটু খুঁজতেই তার পড়শীরাই দেখিয়ে দেন তার বাড়ি। তার মুখেই শোনা ব্যাট বানাবার গল্প।

সঞ্জিৎ বলেন, ‘১৯৮৪ সালের দিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে দিদি বাড়ি বেড়াতে যাই। সেখানে কাঠের তৈরি নানা শিল্পকর্ম দেখে মাথায় আসে নতুন কিছু করার।এরপর দেশে ফিরে ভাইপো উত্তম মজুমদারকে সঙ্গে নিয়ে নতুন কিছু বানানোর চেষ্টা করি। ক্রিকেট আমাকেও খুব টানতো।সেই সুবাদে যশোরের লিডিং স্পোর্টস দোকানের মালিক ও শহরের ঘোপ এলাকার বাসিন্দা বাবু ভাইয়ের সঙ্গে কথা হয়। তিনি আমাদের ক্রিকেট ব্যাট বানানোর পরামর্শ দেন। বাবু ভাইয়ের অনুপ্রেরণায় ১৯৮৬ সালে ভাইপোকে নিয়ে প্রথম ব্যাট তৈরি করি। সেগুলো প্রথমে যশোরে বিক্রি হতো। বাবু ভাই আমাদের আরও ব্যাট বানানোর প্রেরণা দেন। সেই থেকে শুরু। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি আমাদের। পরে এই ব্যাট যশোরের আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।

সঞ্জিত বলেন, ‘১৯৮৬ সালে প্রথম হাতে ব্যাট তৈরি আমরা। সেবছরই সেগুলো স্থানীয় বাজারে বিক্রি শুরু হয়। এ ব্যবসায় আমরা সাফল্য পাওয়ায় আমাদের দেখাদেখি আরও অনেকে ব্যাট তৈরিতে নেমে যান।’

ক্রিকেট ব্যাট তৈরির কারখানা এখন নরেন্দ্রপুরের মিস্ত্রিপাড়া ছাড়িয়ে মহাজেরপাড়া, বলরামপুর, রুদ্রপুর ইত্যাদি গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে। সব মিলিয়ে গড়ে উঠেছে ৬০-৬৫টির বেশি কারখানা। এসব কারখানায় শুরুতে সবকাজ হাতে করা হলেও বর্তমানে অনেকেই তা মেশিনে করছেন। এতে কাজের গতি বেড়েছে।এসব কারখানায় মাসে ৫০ থেকে ৬০ হাজার ব্যাট তৈরি হচ্ছে।

সঞ্জিত জানান, ব্যাট তৈরিতে ব্যবহার করা হয় ছাতিয়ান, কদম, নিম, জীবন, পিঠেগড়া, আমড়াসহ বিভিন্ন প্রকার দেশীয় কাঠ। শ্রমিকদের পাশাপাশি বাড়ির বউ-ছেলেমেয়েরাও টুকটাক কাজ করেন। তাদের কাজের মধ্যে রয়েছে ব্যাটে পুডিং লাগানো, ঘষামাজা করা, স্টিকার লাগানো, প্যাকেটজাত করা ইত্যাদি।

ব্যাট নির্মাণ কাজে নিয়োজিত শ্রমিকরা জানান, একশ’ ব্যাট বানিয়ে দিলে তারা এক থেকে দেড় হাজার টাকা হারে মজুরি পেয়ে থাকেন। তাদের পক্ষে সপ্তাহে চারশ’ ব্যাট তৈরি করা সম্ভব। ব্যাটে পুডিং, স্টিকার লাগানোসহ পালিশের কাজ করেন অন্যরা।

এই এলাকায় ১০-১১ বছর ধরে ক্রিকেট ব্যাট তৈরির কাজ করছেন ওমর আলী। তিনি জানান, ব্যাট প্রতি খরচ ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। বিক্রি হয় ৭০ টাকা। তার অধীনে তিনজন এ কাজ করেন। তিনি বলেন, ‘আগের চেয়ে এখন আমি বেশ ভালই আছি’।

ওমর আলী জানান,‘তাদের তৈরি ব্যাট যশোরের বাজার ছাড়াও বগুড়া, দিনাজপুর, রংপুর অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা নিয়ে যান।’

 

/টিএন/