উন্নয়নের আরেক মাইলফলক

দেশের প্রথম ৬ লেন সেতুর উদ্বোধন আজ

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন নড়াইলের লোহাগড়ার কালনা পয়েন্টে নির্মিত দেশের প্রথম ছয় লেনের দৃষ্টিনন্দন ‘মধুমতি সেতু’ উদ্বোধন হচ্ছে আজ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোমবার (১০ অক্টোবর) দুপুর ১২টায় গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি সেতুটি উদ্বোধন করবেন। উদ্বোধনের দিন থেকেই সেতুতে চলবে গাড়ি। এই সেতু চালু হলে রাজধানী ঢাকা থেকে সড়ক পথে দক্ষিণ-পশ্চিমের দূরত্ব কমবে।

এর মাধ্যমে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্তত ১০ জেলার মানুষের দীর্ঘদিনের দুর্ভোগ লাঘব হবে। সেতুর পূর্ব পাড়ে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলা এবং পশ্চিম পাড়ে নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০০৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর নড়াইলের নির্বাচনি জনসভায় সেতুটি নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করেছিলেন তিনি।

গত ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর যশোর ও নড়াইলসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের কাছে কালনাঘাটে সেতুর প্রয়োজনীয়তা বেড়ে যায়। পদ্মা সেতু পার হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের প্রবেশদ্বার কালনাঘাট। গত ২২ সেপ্টেম্বর সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সেতুটি পরিদর্শন করেন। সেদিন সেতুমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেতুটি উদ্বোধন করবেন’।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কালনাঘাটে নির্মিত মূল সেতু ও সংযোগ সড়কের সব কাজ শেষ হয়েছে। সেতুর অর্ধেক অংশে ল্যাম্পপোস্ট বসানো শেষ। টোল প্লাজার আটটি বুথ বসানো হয়েছে। সেখানে যন্ত্রপাতি বসানোর কাজও সম্পন্ন। গাড়ি চলার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত সেতুটি। সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্ক ইম্প্রুভমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে সেতুটি নির্মাণ হয়েছে।

প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, সেতুর মাঝখানে বসানো হয়েছে ১৫০ মিটার দীর্ঘ স্টিলের স্প্যান। নেলসন লোস আর্চ টাইপের (ধনুকের মতো বাঁকা) স্প্যানটি তৈরি হয়েছে ভিয়েতনামে। ওই স্প্যানের উভয় পাশের অন্য স্প্যানগুলো পিসি গার্ডারের (কংক্রিট)। ছয় লেনের সেতুটি হবে এশিয়ান হাইওয়ের অংশ। চারটি মূল লেনে দ্রুতগতির ও দুটি লেনে কম গতির যানবাহন চলাচল করবে। সেতুর দৈর্ঘ্য ৬৯০ মিটার ও প্রস্থ ২৭ দশমিক ১০ মিটার। উভয় পাশে সংযোগ সড়ক চার দশমিক ২৭৩ কিলোমিটার, যার প্রস্থ ৩০ দশমিক ৫০ মিটার। সেতু নির্মাণে মোট ব্যয় ৯৫৯ দশমিক ৮৫ কোটি টাকা।

kalna-bridge3

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, পদ্মা সেতু চার লেনের হলেও দেশের প্রথম ছয় লেনের সেতু মধুমতি। পদ্মা সেতুর পাইলক্যাপ পানির ওপর পর্যন্ত। কিন্তু এ সেতুর পাইলক্যাপ পানির নিচে মাটির ভেতরে। তাই নৌযান চলাচল সমস্যা হবে না, পলি জমবে না এবং নদীর স্রোতও কম বাধাগ্রস্ত হবে। সওজ ও পরিবহন সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, এই সেতু চালু হলে বেনাপোল স্থলবন্দর থেকে যশোর হয়ে নড়াইলে যাতায়াতকারী পরিবহনগুলো মাগুরা-ফরিদপুর হয়ে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া যাতায়াতের পরিবর্তে কালনা হয়ে পদ্মা সেতু দিয়ে যাতায়াত করতে পারবে। এতে বেনাপোল-ঢাকা ও যশোর-ঢাকার দূরত্ব ১১৩ কিলোমিটার, খুলনা-ঢাকার দূরত্ব ১২১ কিলোমিটার ও নড়াইল-ঢাকার দূরত্ব ১৮১ কিলোমিটার কমবে। একইভাবে ঢাকার সঙ্গে শিল্প ও বাণিজ্যিক শহর নওয়াপাড়া, মোংলা বন্দর ও সাতক্ষীরার দূরত্বও কমে যাবে। এশিয়ান হাইওয়েতে থাকা সেতুটি সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে সিলেটের তামাবিল হয়ে ঢাকা, বেনাপোল ও কলকাতা পর্যন্ত সরাসরি ভূমিকাও রাখবে।

সেতুতে কোন গাড়িত কত টোল

মধুমতি সেতু পারাপারের জন্য বড় ট্রেইলর ৫৬৫, তিন বা ততধিক এক্সসেলবিশিষ্ট ট্রাক ৪৫০, দুই এক্সসেলবিশিষ্ট মাঝারি ট্রাক ২২৫, ছোট ট্রাক ১৭০, কৃষিকাজে ব্যবহৃত পাওয়ার ট্রিলার ও ট্রাক্টর ১৩৫, বড় বাসের ক্ষেত্রে ২০৫, মিনিবাস বা কোস্টার ১১৫, মাইক্রোবাস, পিকআপ, কনভারশন করা জিপ ও রে-কার ৯০, প্রাইভেট কার ৫৫, অটোটেম্পো, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, অটোভ্যান ও ব্যাটারিচালিত তিন চাকার যান ২৫, মোটরসাইকেল ১০ টাকা ও রিকশা, ভ্যান ও বাইসাইকেলের ক্ষেত্রে পাঁচ টাকা টোল নির্ধারণ করা হয়েছে।

সংস্কার প্রয়োজন সংযোগ সড়কের

সেতুটি হওয়ায় স্থানীয়রা খুশি হলেও নড়াইলের কালনা থেকে যশোরের মনিহার পর্যন্ত ১৮ ফুট প্রশস্ত এক লেনের সড়কে ৫২ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন স্থানীয়রা। তাদের দাবি, সেতুর হওয়ায় এই সড়কে গাড়ির চাপ বাড়বে। এখনই সংকীর্ণ আর আঁকাবাঁকা বাইপাস দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে পার হচ্ছে শত শত যানবাহন। সেতু চালু হলে বহুগুণে বাড়বে গাড়ির চাপ।

সড়কটি ছয় লেনে উন্নীত করা হলে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে বেনাপোল স্থলবন্দরসহ ভারতের কলকাতার যোগাযোগ অনেক সহজ হয়ে যাবে। এতে রাজধানীর সঙ্গে বেনাপোল স্থলবন্দরের দূরত্ব কমবে ৮৬ কিলোমিটার। এ ছাড়া নওয়াপাড়া-বেনাপোল-ভোমরা বন্দরসহ খুলনা বিভাগের ১০ জেলার যানবাহন ও পণ্য পরিবহন হবে মধুমতি সেতুর ওপর দিয়ে। সাশ্রয় হবে সময় ও অর্থ।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ভাঙ্গা থেকে বেনাপোল পর্যন্ত এক লেন সড়কের প্রশস্ত ১৮-২৪ ফুট। সড়কে নড়াইল-যশোর অংশে ঝুঁকিপূর্ণ কয়েকটি সংকীর্ণ সেতু ও কালভার্ট রয়েছে। সড়ক প্রশস্ত না হওয়ায় ১০০ কিলোমিটার বেশি ঘুরে রাজধানী থেকে বেনাপোল বন্দরসহ দক্ষিণ-পশ্চিমের বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছে মানুষ। এতে সময় ও অর্থ অপচয় হচ্ছে। নড়াইল শহরের ভেতর দিয়ে পাঁচ কিলোমিটার আঁকাবাঁকা আর সরু বাইপাস সড়ক রয়েছে। সড়ক সংলগ্ন এলাকায় রয়েছে ১২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ফলে সড়কের এই অংশেই যানজট আর দুর্ঘটনার আশঙ্কা সর্বাধিক।

kalna-bridge2

ঈগল পরিবহনের লোহাগড়ার ম্যানেজার মো. এনামুল হক বলেন, আমাদের কোম্পানির যশোর-বেনাপোলের সব গাড়ি নড়াইলের ওপর দিয়ে ঢাকা যাবে। অন্যান্য পরিবহনসহ পণ্য পরিবহনের সব গাড়ি নড়াইলে ঢুকলে সমস্যা সৃষ্টি হবে। যানজট ও দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকবে।

নড়াইল জেলা বাস-মিনিবাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কাজী জহিরুল হক বলেন, ‘পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর নড়াইলের সড়ক দিয়ে যানবাহনের চাপ অনেক বেড়ে গেছে। মধুমতি সেতু চালু হলে তা আরও বহুগুণে বাড়বে। সড়ক সরু ও ঝুঁকিপূর্ণ থাকায় যানজট ও দুর্ঘটনার মারাত্মক ঝুঁকিতে থাকবে এই অঞ্চল।’

নড়াইলের শ্রমিক নেতা মিজানুর রহমান মিন্টু বলেন, ‘কালনা থেকে যশোরের মনিহার সিনেমা হল পর্যন্ত সড়ক প্রশস্ত না হওয়ায় দুর্ঘটনার আশঙ্কা নিয়ে মধুমতি সেতু চালু হচ্ছে।’ তিনি দ্রুত সড়ক প্রশস্ত করার দাবি জানান।

ঝুলে আছে ভাঙ্গা-কালনা-যশোর-বেনাপোল ৬ লেন সড়ক প্রকল্প

সড়ক ও জনপথ বিভাগ বলছে, ভাঙ্গা-যশোর-বেনাপোল ১৩০ কিলোমিটার সড়ক ছয় লেনে উন্নতি করার জন্য ১১ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি এখনও অনুমোদন হয়নি। তবে খুব দ্রুত প্রকল্পটি একনেকের সভায় অনুমোদিত হবে।

সড়ক বিভাগ জানায়, ভাঙ্গা-যশোর-বেনাপোল জাতীয় মহাসড়ক ছয় লেনে উন্নীতকরণে ১১ হাজার কোটি টাকার ডিপিপি তৈরি হয়েছে। রোডের নকশার কাজ শেষ হয়েছে অনেক আগেই। এরমধ্যে পাঁচটি ফ্লাইওভার রয়েছে এবং নড়াইল ও যশোর অংশে পৃথক দুটি বাইপাস হবে। প্রকল্পের মধ্যে নড়াইল শহরে বাইপাস সড়ক রয়েছে। আপাতত কালনা থেকে যশোর পর্যন্ত দুই পাশে তিন ফুট চওড়া করার কাজ চলছে। শহর বাইপাস এলাকায় মাত্র তিন ফুট রাস্তা বেড়ে হবে ১৮ ফুট।

নড়াইল সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুজ্জামান বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর ভাঙ্গা-যশোর-বেনাপোল জাতীয় মহাসড়ককে ছয় লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পের কাজ অফিসিয়ালি চলমান রয়েছে। আপাতত চাপ সামলাতে কালনা থেকে যশোর পর্যন্ত বর্তমান সড়কটি আরও ছয় ফুট পিচ ঢালাই করে চওড়া করা হবে। দেড় বছরের মধ্যে এর কাজ শেষ হবে। তবে ছয় লেনে উন্নীতকরণের কাজ শুরু হলে পাঁচ বছরের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।’

নড়াইল জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেন, ‘ছয় লেন প্রকল্পের নড়াইল অংশে ২৭৪ একর জমির অধিগ্রহণের হিসাব ২০২০ সালে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। প্রকল্পের অর্থায়ন জিটুজি পর্যায়ে রয়েছে। অর্থায়ন নিশ্চিত হলেই কাজ শুরু হবে। আশা করি দ্রুতই কাজ শুরু করা যাবে।’