বাগেরহাট সদর উপজেলার বেমরতা ইউনিয়নের চিতলী-বৈটপুর গ্রামে বাবা-মায়ের কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি মোহাম্মদ রফিক। সোমবার (৭ আগস্ট) বেলা ১১টায় চিতলী-বৈটপুর এলাকায় উদ্দিপন বদর সামছু বিদ্যা নিকেতনে নামাজে জানাজা হয়। এরপর কবির দাফন সম্পন্ন হয়।
কবির শেষ বিদায়ে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বশির আহমেদ, কবির বোন জামাই শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. আমিনুল হক, বোন গাইনি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. সেলিনা পারভীন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক সবিতা ইয়াসমিন, কবির ভাই প্রকৌশলী শফিক, কবির ছোট ছেলে অধ্যাপক ড. শুদ্ধস্বত্ব রফিক, স্বজন ও লেখক অধ্যাপক প্রশান্ত মৃধা, সামছউদ্দিন নাহার ট্রাস্টের প্রধান সমন্বয়ক সুব্রত কুমার মুখার্জীসহ স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিসহ কবির গুণগ্রাহীরা উপস্থিত ছিলেন।
প্রিয় কবিকে হারিয়ে শোকাহত হয়ে পড়েছেন শিক্ষার্থী, স্বজন ও স্থানীয়রা। তার ভাই প্রকৌশলী মো. শফিক বলেন, আমাদের আট ভাইবোনদের মধ্যে মোহাম্মদ রফিক সবার বড় ছিলেন। তিনি শুধু আমাদের বড় ভাই ছিলেন না, আমাদের সবার অভিভাবক ছিলেন। তার মৃত্যুতে আমরা অভিভাবক শূন্য হলাম।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী মমিনুল ইসলাম বলেন, স্যার একজন ভালো নিরহঙ্কার মানুষ ছিলেন। দেশের জন্য তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। দেশের জন্য তার কলম চলতো সব সময়। স্যারের অবদান ভোলার নয়।
নামাজে জানাজা ও দাফন শেষে বাবার জন্য সবাকে দোয়া চান কবির ছোট ছেলে অধ্যাপক ড. শুদ্ধস্বত্ব রফিক।
ষাটের দশকে ছাত্র আন্দোলন ও কবিতায়, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে এবং স্বাধীন বাংলাদেশে আশির দশকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে কাব্যিক রসদ জুগিয়ে বিখ্যাত হয়ে আছেন মোহাম্মদ রফিক।
১৯৪৩ সালের ২৩ অক্টোবর বাগেরহাট সদর উপজেলার বেমরতা ইউনিয়নের বৈটপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা সামছুদ্দীন আহমদ ও মা রেশাতুন নাহারের আট সন্তানের মধ্যে মোহাম্মদ রফিক ছিলেন সবার বড়। শৈশব কাটে বাগেরহাটে। মেট্রিক পাস করে ঢাকার নটরডেম কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হন, কিন্তু পরে ঢাকা কলেজে মানবিক বিভাগে চলে যান। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে এম এ ডিগ্রি লাভ করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি পাকিস্তানের সামরিক শাসন বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত হন। পাকিস্তানের সামরিক আদালত তাকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয়, কিন্তু এম এ পরীক্ষার জন্য ছাড়া পান। ১৯৭১ সালে তিনি প্রথমে মুক্তিযুদ্ধের ১নং সেক্টরের কর্মকর্তা হিসেবে এবং পরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কাজ করেন। মুক্তিযুদ্ধের পর বিভিন্ন কলেজে শিক্ষকতা করার পর তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন।
তিনি দীর্ঘ সময় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রধান ছিলেন। ২০০৯ সালের ২৯ জুন তিনি অবসরে যান। অবসরের পর কবি মোহাম্মদ রফিক রাজধানীর মোহাম্মাদপুরে বসবাস করতেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত রোগসহ বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন। গত সপ্তাহে ছোট ছেলের সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে আসেন। গ্রামের বাড়ি বাগেরহাটের চিতলীতে অবস্থানকালে রবিবার (৬ আগস্ট) সকালে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন।
তখন প্রথমে বাগেরহাট এবং পরে বরিশাল নেওয়া হয়। বরিশালের একটি বেসরকারি ক্লিনিকে বিভিন্ন পরীক্ষার পর হার্টের সমস্যাসহ বেশি কিছু শারীরিক জটিলতা ধরা পড়লে চিকিৎসকরা তাকে ঢাকা নেওয়ার পরামর্শ দেন। সন্ধ্যায় পরিবারের সদস্যরা তাকে নিয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকার উদ্দেশে রওনা হওয়ার পর পথেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
কবি মোহাম্মদ রফিক ঢাকায় থাকলেও, এলাকার মানুষের আর্থসামাজিক, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের উন্নয়ন পৈতৃক ভিটায় সব ভাইবোনরা মিলে সামছুউদ্দিন নাহার ট্রাস্ট নামের একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা গড়ে তুলেছিলেন। কবি ট্রাস্টি বোর্ডের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। তিনি আমৃত্যু সামছুউদ্দিন নাহার ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ছিলেন।
১৯৭০ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘বৈশাখী পূর্ণিমা’ প্রকাশিত হয়। ১৯৭৬ সালে প্রকাশ পায় তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ধুলার সংসারে এই মাটি’। মোহাম্মদ রফিক একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, প্রথম আলো বর্ষসেরা গ্রন্থ পুরস্কার, জেমকন সাহিত্য পুরস্কারসহ বিভিন্ন স্বীকৃতি ও পুরস্কার অর্জন করেছেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে ‘কপিলা’, ‘খোলা কবিতা, ‘গাওদিয়া’, ‘মানব পদাবলী’, ‘আত্মরক্ষার প্রতিবেদন’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।