নালিতাবাড়ীর শহর রক্ষা বাঁধের ২৫০ মিটার নদী গর্ভে বিলীন

ভোগাই নদীর শহর রক্ষা বাঁধের আড়াই আনী বাজারের পূর্ব অংশে নদী ভেঙে লোকালয়ে প্রবেশ করেছে শেরপুরের নালিতাবাড়ীর ভোগাই নদীতে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের ফলে নাকুগাঁও স্থলবন্দর এলাকার ভোগাই ব্রিজটি  হুমকির মুখে পড়েছে। সেই সঙ্গে হুমকিতে রয়েছে সীমান্তের বুরুঙ্গা এলাকার অপর একটি ব্রিজ। পৌর শহর এলাকায় ভোগাই নদীতে গত দেড় বছর ধরে চলছে বালু দস্যুদের লুটপাট। এতে নদীগর্ভে বিলীন হতে চলেছে নালিতাবাড়ী শহর রক্ষা বাঁধ। এছাড়াও শহরের গুরুত্বপুর্ণ বেশ কয়েকটি স্থাপনা হুমকির মুখে রয়েছে।

২০১৯ সালে স্থানীয় এক শ্রেণির প্রভাবশালী বালু ব্যবসায়ী ভোগাই নদীর বিভিন্ন অংশে অপরিকল্পিতভাবে স্যালো মেশিন বসিয়ে পাইপের মাধ্যমে যত্রতত্র বালু উত্তোলন শুরু করে। প্রশাসনের নাকের ডগায় নদী থেকে বালু তোলার ফলে শহর রক্ষা বাঁধের বিভিন্ন অংশে ফাটল দেখা দেয়। বর্তমানে দেড় কিলোমিটার বাঁধের বিভিন্ন অংশে প্রায় ২৫০ মিটার  নদী গর্ভে চলে গেছে।

নালিতাবাড়ী শহরের কাচারী পাড়া মহল্লার বাসিন্দা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান রিপনের  সদ্য নির্মিত বাড়ির পেছনের অংশে বাঁধ ভেঙে গেছে। এতে নতুন ভবনটি হুমকির মুখে পড়েছে। বাঁশের খুঁটি ও বালুর বস্তা ফেলে তারা বাড়িটি রক্ষার চেষ্টা করছেন। এছাড়া আমবাগান এলাকায় সাবেক নৌ-পরিবহন সচিব আব্দুস সামাদ ফারুকের বাড়ির পাশে ব্লক ভেঙে গেছে। সেখানে পানি উন্নয়ন বোর্ড ১৪ লাখ টাকা ব্যয়ে ৫০ মিটার এলাকা জুড়ে ৫ হাজার বালুর বস্তা ফেলে বেরিক্যাড দিয়েছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ অপরিকল্পিতভাবে বাঁধের ব্লকের সামনে হাজার হাজার বালুর বস্তা ফেলায় নদীর পানির প্রবাহ গতি পরিবর্তন করেছে এবং পানি পাক খেয়ে পূর্ব দিকে গিয়ে আঘাত করছে। এতে আমানুল্লাহ রাইস মিল ও দেওয়ান রাইস মিল এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হতে চলেছে।

স্থানীয় তারাগঞ্জ আলিম মাদ্রাসাটিও নদী ভাঙনের কবলে। আমবাগান এলাকার আইনজীবী গোলাম কিবিরয়া বুলু, সাংবাদিক এমএ হাকাম হীরা ও আনোয়ার মঞ্জিলের বাড়ি ও থানা মসজিদসহ বেশ কয়েকটি বসতবাড়ি হুমকির মুখে রয়েছে।

ঝুঁকির মুখে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান রিপনের সদ্য নির্মিত বাড়ি শেরপুর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের পিপি অ্যাডভোকেট গোলাম কিবিরয়া বুলু বলেন, বালুখেকোর দল যত্রতত্র বালু তোলায় নদী গভীর হয়ে গেছে। ফলে পাহাড়ি ঢল এলে শহর রক্ষা ব্লকের নিচে পানি আঘাত হানছে। এতে ধীরে ধীরে বাঁধটি ভেঙে পড়ছে।

শেরপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবু সাইদ বলেন, অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের ফলে বাঁধের বেশ কয়েকটি অংশে ভেঙে পড়ছে। শহর রক্ষা বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ভাঙন রোধে আমরা যে প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়েছি তা পরিকল্পিত। শহরের আশপাশে যাতে কেউ বালু তুলতে না পারে উপজেলা প্রশাসন তার ব্যবস্থা নিলে বাঁধটি ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।

নালিতাবাড়ীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহফুজুল আলম মাসুম বলেন, আমি নালিতাবাড়ীতে যোগদান করার পর ঘোষণা দিয়েছি সেতু বা বিজ্রের এক কিলোমিটারের মধ্যে কেউ বালু তুলতে পারবে না। ইতোমধ্যে এক ব্যবসায়ীকে অবৈধ বালু তোলার দায়ে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন উপজেলার ১০ জন ইউপি চেয়ারমান বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে সড়ক ও সেতুমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেছেন। আবেদনটি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে।

উল্লেখ্য, নালিতাবাড়ী শহরের বুক চিরে বয়ে চলেছে পাহাড়ি খরস্রোতা নদী ভোগাই। আশির দশকে ভোগাইকে নালিতাবাড়ীর দুঃখ বলা হতো। প্রতি বছর বর্ষা এলে চরম দুর্ভোগ পোহাতো মানুষ। বর্তমান পৌর শহরটি ডুবে যেতো পানিতে। ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যেতো। নদীর পানিতে ডুবে সে সময় অসংখ্য মানুষ মারা যায়।

১৯৯১ সালে প্রথমবারের মতো নালিতাবাড়ী-নকলা আসনের (শেরপুর- ০২) এমপি হয়ে সাবেক কৃষিমন্ত্রী  বেগম মতিয়া চৌধুরী শহর রক্ষা বাঁধ করার জন্য তৎকালীন সরকারের কাছে দাবি জানান। তৎকালীন সরকার বাঁধটি করতে অনীহা দেখালে এর প্রতিবাদে ১৯৯২ সালের নভেম্বর মাসে তিন দিনের অনশনের ডাক দেন মতিয়া চৌধুরী। এ সময় তিনি একটানা ২৪ ঘণ্টা অনশন করেন। মতিয়া চৌধুরীর অনশনে সরকার বাধ্য হয় বাঁধ তৈরি করে দিতে। ১৯৯৩ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ড বাঁধ নির্মাণ কাজের দরপত্র আহ্বান করেন। ১৯৯৪ সালে প্রায় দুই কোটি টাকা ব্যয়ে বাঁধটি নির্মাণ শুরু হয়।

পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে কৃষিমন্ত্রী হন মতিয়া চৌধুরী। তিনি বাঁধের জন্য  আরও দুই কোটি টাকা বরাদ্দ এনে দেন। ১৯৯৯ সালে কংক্রিট ব্লক দিয়ে শহরের তারাগঞ্জ ছিটপাড়া শহীদ আব্দুর রশিদ মহিলা কলেজ থেকে কাচারীপাড়া গঙ্গা মন্দির পর্যন্ত দেড় কিলোমিটার শহর রক্ষা বাঁধ নির্মিত হয়। শত বছরের দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পান শহরবাসী। পরবর্তীতে ভোগাইয়ের ভাঙন রোধে প্রায় প্রতি বছর নিজের টিআর-কাবিটা থেকে তিনি পরিকল্পিতভাবে ভোগাই নদীর বিভিন্ন পয়েন্ট খনন করে আসছিলেন। এর ফলে পাহাড়ি ঢল ও বন্যা হলেও নালিতাবাড়ীতে ক্ষয়-ক্ষতি অনেক কম হয়।