যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা সেজে কোটিপতি, নিয়েছেন সরকারি ফ্ল্যাট

তারা মিয়া ছিলেন ‘রাজাকার’। সময়ের ব্যবধান আর সড়ক দুর্ঘটনায় পঙ্গু হওয়ার পর ধীরে ধীরে অনেকটা আড়াল হয়ে পড়ে অতীত কর্মকাণ্ড। তবে বসে থাকেননি। নিজের বাবার নাম গোপন করে অন্য একজনের নাম ব্যবহার করে বনে যান মুক্তিযোদ্ধা। সড়ক দুর্ঘটনায় আহত অবস্থাকে পুঁজি করে নাম লেখান যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার তালিকায়। মুক্তিযোদ্ধা সেজে সরকারি নানা সুযোগ-সুবিধা নিয়ে হয়ে যান কোটিপতি।

ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার আঠারবাড়ী ইউনিয়নের ইটাউলিয়া গ্রামের বাসিন্দা তারা মিয়াকে (৭০) বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চেনেন এলাকাবাসী। সম্প্রতি যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের জারি করা পরোয়ানায় তাকে বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। এরপর থেকে তাকে নিয়ে উপজেলাজুড়ে চলছে সমালোচনা।

ঈশ্বরগঞ্জের স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার (২১ অক্টোবর) পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়া তারা মিয়ার চার ভাই। তিনি ছাড়া অন্য তিন ভাই বাবার নাম হিসেবে শাহনেওয়াজ ব্যবহার করেন। একমাত্র তারা মিয়ার বাবার নাম ‘শমসের আলী’। 

গৌরীপুর উপজেলার ধোপাজাঙ্গালিয়া গ্রামে তারা মিয়া (মুক্তিযোদ্ধা নম্বর ৯৭৯৩) নামে ভাতাভোগী এক বীর মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। যার বাবার নাম শমসের আলী। তারা মিয়া বিষয়টি জানতে পেরে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টে তদবির করে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকায় নাম তোলেন। এর সুবাদে বাগিয়ে নেন ঢাকার মোহাম্মদপুরে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকারিভাবে নির্মিত বহুতল ভবনে চার কক্ষবিশিষ্ট একটি ফ্ল্যাট; যার দাম এক কোটি টাকা। এখানেই থেমে থাকেননি। ঈশ্বরগঞ্জের আঠারোবাড়ী ইউনিয়নের রায়ের বাজার এলাকায় নিজ গ্রাম ইটাউলিয়ায় সরকারিভাবে বরাদ্দ পান ১০ শতাংশ জমি। গত ১০ বছর ধরে প্রতিমাসে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে উত্তোলন করতেন ৩০ হাজার টাকা ভাতা। এভাবেই কোটিপতি হন রাজাকার তারা মিয়া।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ও বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট্রের ব্যবস্থাপনা পরিচালক স্বাক্ষরিত ২০১১ সালের ১ জুলাই ইস্যু করা পরিচয়পত্রে তারা মিয়ার নাম যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

তারা মিয়ার ছেলে আবুল কালাম বলেন, স্থানীয় একটি চক্র আমার বাবার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ উত্থাপন করেছে। আমার বাবা ষড়যন্ত্রের শিকার।

আঠারবাড়ী ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার রঞ্জন ঘোষ বলেন, তারা মিয়া মুক্তিযোদ্ধা নন। পাশের উপজেলার এক বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম ও বাবার নামের মিল থাকার সুযোগে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের অসাধু কর্মকর্তাদের মাধ্যমে তালিকাভুক্ত হন। তার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কাছিমপুরের লতিফ মাস্টারকে প্রকাশ্যে হত্যার অভিযোগ রয়েছে। তা ছাড়া পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ঘেরাওয়ের কাজে সক্রিয় ভূমিকা ছিল তার। আমরা যখন জানতে পারি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছেন, তারপর একাধিকবার মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রতিবেদন পাঠিয়েছি।

উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার মো. তোফাজ্জল হোসেন বলেন, মুক্তিযোদ্ধার পরিচয়ে একজন রাজাকার অনেক কিছুই করেছেন। তাকে বঙ্গভবনেও যাতায়াত করতে দেখেছি। হয়েছেন কোটিপতি। সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালের তদন্ত কর্মকর্তারা তারা মিয়ার বিরুদ্ধে হত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের সত্যতা পেয়েছেন।

ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডের সাবেক কমান্ডার আব্দুস সাত্তার বলেন, ২০১৭ সালে উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ের সময় তারা মিয়া মুক্তিযোদ্ধা নয়- মর্মে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছিল। সর্বশেষ মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে উপজেলার ১২ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ জমা দেওয়া হয়। তদন্ত শেষে ট্রাইব্যুনাল থেকে জারি করা ওয়ারেন্টের ভিত্তিতে তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তারা মিয়ার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।

ঈশ্বরগঞ্জ থানার ওসি আব্দুল কাদের বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তদন্ত শেষে ২১ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ১২ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। সেটি আমলে নিয়ে তারা মিয়াকে গ্রেফতার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়।