মমেক হাসপাতাল ঘিরে অনুমোদনহীন ক্লিনিক-ল্যাবের ছড়াছড়ি

ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ (মমেক) হাসপাতালকে ঘিরে চারপাশে গড়ে উঠেছে অসংখ্য অনুমোদনবিহীন ও মানহীন প্রাইভেট ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ল্যাব। অভিযোগ উঠেছে, এক শ্রেণির চিকিৎসককে কমিশনের ফাঁদে ফেলে সরকারি হাসপাতালের রোগীদের এসব ক্লিনিক-ল্যাবে রোগ নির্ণয়ের বিভিন্ন পরীক্ষা করাতে বাধ্য করা হচ্ছে রোগীদের। তবে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে এসব অবৈধ ক্লিনিক-ল্যাবের তালিকা করা হচ্ছে। শিগগিরই এগুলোর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

স্থানীয়রা বলছেন, স্বাস্থ্য বিভাগের নাকের ডগায় গড়ে ওঠা এসব ক্লিনিক ও ল্যাবে ভুল চিকিৎসাসহ রোগীরা প্রতিনিয়ত প্রতারিত হলেও কোনও প্রতিকার মিলছে না। এসব অবৈধ চিকিৎসাসেবা কেন্দ্রে ভুল চিকিৎসার ফলে ঘটছে নানা অপ্রীতিকর ঘটনাও। অভিযোগ রয়েছে, ব্যাঙের ছাতার মতো মানহীন ক্লিনিক ও প্রাইভেট হাসপাতাল গড়ে উঠলেও স্বাস্থ্য বিভাগের স্থানীয় কর্মকর্তারা নীরব থাকেন।

নাম সর্বস্ব এসব ক্লিনিক-ল্যাবের সঙ্গে মমেক হাসপাতালের এক শ্রেণির কমিশনভোগী চিকিৎসকের সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয় একাধিক ল্যাব মালিক দাবি করেন, ডিগ্রিধারী পরীক্ষকদের দিয়ে নির্ভুল রিপোর্ট দেওয়া হলেও ময়মনসিংহ মেডিক্যালের এক শ্রেণির চিকিৎসক নির্ধারিত ল্যাবের বাইরের কোনও রিপোর্ট গ্রহণ করছেন না।
 
তারা বলছেন, মূলত শহরের নামিদামি ল্যাবগুলো একশ্রেণির চিকিৎসককে অগ্রিম কমিশন দেওয়ার রেওয়াজ চালু করেছে। আবার মধ্যম সারির কিছু ল্যাব এই কমিশন নগদ পৌঁছে দিচ্ছে। এতে করে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং মেডিক্যাল কলেজের আধুনিক ও নির্ভরযোগ্য ল্যাবে বেশিরভাগ রোগ নির্ণয়ের ব্যবস্থা থাকলেও কর্তব্যরত চিকিৎসকরা কমিশনের লোভে রোগীদের বাইরের এসব ল্যাবে পাঠাচ্ছেন। ফলে একদিকে যেমন হাসপাতালের ভাবমূর্তি ও সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে, অন্যদিকে রোগীদেরও গুণতে হচ্ছে বাড়তি টাকা।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, নগরীর চরপাড়া, নয়াপাড়া, কপি ক্ষেত, মাসকান্দা, ব্রাহ্মপল্লী, বাঘমারা, ভাটিকাশর, কৃষ্টপুর, পাটগুদাম, রামকৃষ্ণমিশন রোড, সাহেবআলী রোড, চামড়াগুদাম ও কালিবাড়ি রোডসহ বিভিন্ন অলিগলিতে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে অসংখ্য প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্যাথলজি ল্যাব। বিশেষ করে চরপাড়া এলাকায় অবস্থিত মমেক হাসপাতালের চারপাশে এসব হাসপাতাল-ল্যাবের ছড়াছড়ি অবস্থা। আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকাতেও রয়েছে অসংখ্য ক্লিনিক ও ল্যাব।

ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালকে ঘিরে অসংখ্য অবৈধ ক্লিনিক-ল্যাব

মূলত মমেক হাসপাতালের ওপর ভর করেই গড়ে উঠেছে এসব নাম সর্বস্ব হাসপাতাল ক্লিনিক ও ল্যাব। হাসপাতালের এক শ্রেণির চিকিৎসকদের ম্যানেজ করেই সরকারি হাসপাতালে আসা রোগীদের রাস্তা থেকে, এমনকি অনেক সময় ভর্তির পর হাসপাতাল থেকে ভাগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এসব হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ল্যাবের দালালচক্র। আর মমেক হাসপাতালে বর্তমানে রোগ নির্ণয়ের প্রায় সব ধরনের পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও কমিশনভোগী চিকিৎসকরা বাড়তি আয়ের জন্য অসহায় রোগীদের স্লিপে ল্যাবের নাম লিখে বাইরে পাঠাচ্ছে। হাসপাতালের অনেক চিকিৎসক আবার এসব হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ল্যাবের সাথে সরাসরি জড়িত থাকারও অভিযোগ রয়েছে।

স্থানীয় একটি সূত্র জানায়, সরকারি হাসপাতালের কমিশনভোগী এসব চিকিৎসকের অধিকাংশই একাধিক গাড়ি-বাড়ির মালিক। ময়মনসিংহ শহরের অধিকাংশ প্রাইভেট কারের মালিকও এসব চিকিৎসক, দাবি ওই সূত্রের।

ময়মনসিংহ জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের দেওয়া তথ্যমতে, খোদ ময়মনসিংহ শহরে প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিক ল্যাব রয়েছে প্রায় ২০০টি। কিন্তু বেসরকারি হিসাবে এই সংখ্যা কমপক্ষে দ্বিগুণ। সরকারি তালিকায় যেসব প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিক ল্যাব রয়েছে তাদের বেশিরভাগ বছরের পর বছর ধরে নবায়ন করছে না। হাসপাতাল পরিচালনার অনুমোদন নিয়ে অনেকে ল্যাব খুলে বসেছে। এছাড়া এসব হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ল্যাবে নেই কোনও ডিপ্লোমাধারী নার্স ও প্রশিক্ষিত আয়া। সার্বক্ষণিক চিকিৎসক দেখানো হয় কেবল খাতায়, আয়াদের নার্সের পোশাক পরিয়ে রোগীদের সাথে প্রতিনিয়ত প্রতারণা করা হচ্ছে। অনেক ল্যাবে ভুয়া টেস্টের রিপোর্ট দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে।

সংশ্লিদের মধ্যে প্রচার রয়েছে, একই পরীক্ষকের প্যাড ও সিল ব্যবহার করে রিপোর্ট দেওয়া হচ্ছে অসংখ্য ল্যাব থেকে। বাস্তবে একজন পরীক্ষকের পক্ষে এত ল্যাবে গিয়ে এসব রিপোর্ট দেখা সম্ভব নয়।

শহরের ব্রাহ্মপল্লী আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকাতে দেখা গেছে, বাণিজ্যিক মার্কেটের নিচতলায় খাবারের রেস্তোরাঁর পাশে প্যাথলজিক্যাল ল্যাব। দোতলায় হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিক। তার ওপরে অন্য কোনও প্রতিষ্ঠান। আবাসিক বাসাবাড়ি কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশেও রয়েছে এমন হাসপাতাল ও ল্যাব। অনুমোদন রয়েছে এমন সব হাসপাতাল ক্লিনিক ও ল্যাবেও রয়েছে নানা অব্যবস্থাপনা। হাতেগোনা ১০ থেকে ১৫টি ছাড়া অনুমোদিত সবকটি হাসপাতাল ও ল্যাব চলছে সব নিয়ম ও শর্ত অমান্য করে।

বাংলাদেশ প্রাইভেট ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন, ময়মনসিংহ জেলা শাখার সভাপতি ডা. হরিশংকর দাশ জেলার স্বাস্থ্য খাতে এসব অব্যবস্থাপনার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা অনুমোদনহীন হাসপাতাল ক্লিনিক ল্যাব বন্ধ করে দেওয়ার পক্ষে। জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ চাইলে অনুমোদনহীন ও মানহীন হাসপাতাল ক্লিনিক ল্যাব সিলগালা করে বন্ধ করে দিতে পারে।’ এর ফলে রোগী ও স্বজনেরা কোনও ধরনের প্রতারণার শিকার হবে না বলেও জানান তিনি।

ময়মনসিংহ জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো. নজরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে জেলার অনুমোদনবিহীন প্রাইভেট ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ল্যাবের তালিকা করা হচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তা নিয়ে তালিকা ধরে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।