রাজশাহীতে হতদরিদ্রের তালিকায় 'স্বজন' ও 'সচ্ছলরা'!

rajshahiরাজশাহীর বিভিন্ন উপজেলায় দশ কেজি চাল বিতরণ নিয়ে চেয়ারম্যান ও ডিলারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে।
এর মধ্যে দুর্গাপুর উপজেলার পানানগর ইউনিয়নে চাল বিতরণে চেয়ারম্যান আজাহার আলী খাঁন অধিকাংশ কার্ডই আত্মীয়-স্বজনদের নামে বরাদ্দ দিয়েছেন  বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। বিষয়টি নিয়ে গত সোমবার (১০ অক্টোবর) উপজেলা নির্বাহী অফিসারসহ বিভিন্ন দফতরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন পানানগর ইউনিয়নের সাধারণ মানুষের পক্ষে এলাকার তমির উদ্দিনের ছেলে খলিল উদ্দিন।
লিখিত অভিযোগ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সরকারের নেওয়া খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় দুর্গাপুরের পানানগর ইউপিতে মোট ৯১৯ জন হতদরিদ্রের তালিকা তৈরি করা হয়। ইতোমধ্যে প্রথম দফায় ৪৫৪ জন ১০ টাকা কেজি দরে চাল উত্তোলন করেছে।
এই তালিকায় থাকা হতদরিদ্রদের নামের পাশেই রয়েছে পানানগর গ্রামের আবুল হোসেন শেখের নাম। যার কার্ড নম্বর ৪৬২। অথচ তার ইটের তৈরি একটি বাড়ি রয়েছে। তালিকায় নাম থাকা একই গ্রামের আলিমুদ্দিনেরও রয়েছে ফ্লাট বাড়ি। কার্ড নম্বর ৩০২।
এছাড়া তালিকায় নাম থাকা একই গ্রামের শামসুল ইসলামের (কার্ড নম্বর ৩৯২) রয়েছে প্রায় ৩০ বিঘা আবাদি জমি। চেয়ারম্যান আজাহার আলী খাঁনের আপন ছোট ভাই মৎস্য ব্যবসায়ী মোজাম্মেল খাঁনের (কার্ড নম্বর ৪২৮) রয়েছে পাকা বাড়ি ও প্রায় ২০ বিঘা আবাদী জমি। এছাড়া বিভিন্ন এলাকায় তার নিজের লিজ নেওয়া পুকুর রয়েছে প্রায় ১০টি।

একই গ্রামের আফছার আলী খাঁন পানানগর দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। তার ছেলে আনারুল ইসলামও (কার্ড নম্বর ৪১৩) রয়েছে হতদরিদ্রের ওই তালিকায়। চেয়ারম্যান আজাহারের ভাতিজা কাওসার আলী, মামাতো ভাই সাইদুল ইসলাম ও বাবুল হোসেন, খালাতো ভাই শাহজাহান আলী ও নজরুল ইসলা নজু এবং ফুফাতো ভাই মুকিদ সরদারের নামও রয়েছে ওই তালিকায়।

এছাড়া ডাঙ্গিরপাড়া গ্রামের জয়েন উদ্দিনের রয়েছে ছাদ ঢালাই পাকা বাড়ি। এছাড়া ওই তালিকায় নাম রয়েছে চেয়ারম্যানের চাচাতো ভাই মাবুল হোসেন ও তার স্ত্রী মর্জিনা বেগমের। মাবুল হোসেনের ভাই রহমানের নামও রয়েছে ওই তালিকায়।

এভাবেই একই পরিবারের একাধিক ব্যক্তি ও নিজের আত্মীয়-স্বজনের নামে নিয়ম বহির্ভুতভাবে কার্ড ইস্যু করেছেন চেয়াম্যান আজাহার আলী খাঁন।

আওয়ামী লীগ সমর্থক খলিল উদ্দিন বলেন, সরকারের অর্জন ম্লান করতেই পরিকল্পিতভাবে চেয়ারম্যান আজাহার আলী খাঁন দশ টাকা কেজির চাল বিক্রির কার্ড ইস্যু করতে এ ধরনের অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতি করায় আমি দরিদ্র ও সাধারণ মানুষের পক্ষ হয়ে বিভিন্ন সরকারি দফতরে অভিযোগ করেছি।

পানানগর ইউপি চেয়ারম্যান আজাহার আলী খাঁন তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন দাবি করে জানান, তার এক ভাই চাল কিনে ভাত খায়, এজন্য তাকে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

আত্মীয়করণ ও স্বজনপ্রীতি করা হয়নি দাবি করে তিনি বলেন, ফেয়ার প্রাইস কার্ডের তালিকা ব্যাপক যাচাই-বাছাই করে তৈরি করা হয়েছে।

এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আক্তারুন্নাহার বলেন, এ বিষয়ে একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি তদন্ত করে প্রমাণিত হলে চেয়ারম্যান আজাহার আলীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সরকারের এই উদ্যোগ কোনোভাবেই ম্লান হতে দেওয়া হবে না।

এদিকে রাজশাহীর গোদাগাড়ীর আদিবাসী এলাকায় দুই মাসের টিপসই ও স্বাক্ষর নিয়ে এক মাসের দশ টাকার চাল বিতরণ করার অভিযোগ পাওয়া গেছে দুই ডিলারের বিরুদ্ধে। এরা হলেন, গোদাগাড়ীর গোগ্রাম ইউনিয়ন কৃষকলীগের সাধারণ সম্পাদক তৌহিদুল ইসলাম ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সভাপতি মিজানুর রহমান।

জানা গেছে, গোদাগাড়ী উপজেলার ৯ ইউনিয়নে কার্ড সংখ্যা প্রায় ১৪ হাজার। ৯ ইউনিয়নে মোট ১৮ জন ডিলার রয়েছেন। প্রতি মাসে ১৮ ডিলার ৪২০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ পাচ্ছেন। তবে এক মাসের চাল দিয়ে দুই মাসের স্বাক্ষর ও টিপসই নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে উপজেলার গোগ্রাম ইউনিয়নের গড়ডাইং গ্রামে।

এই গ্রামে শতঘর আদিবাসীর মধ্যে ১০ টাকা কেজি চালের কার্ড পেয়েছেন ৭ জন। এদের মধ্যে নিমাই সরেন (কার্ড নং-৯৬৪), পরমেশ্বর মারান্ডি (কার্ড নং-৯৬৩), মঙলা উঁরাও (কার্ড নং-৯৪৬) ও অনিল টুডু (কার্ড নং-৯৬২) দুই ডিলারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে জানান, তারা সই করতে পারেন না। টিপসই দিতে পারেন।

এ ব্যাপারে নিমাই সরেন জানান, গত ২৭ সেপ্টেম্বর তাকে কার্ড হস্তান্তর করেন ডিলার। ওইদিন কোন চাল দেওয়া হয়নি। কার্ড হস্তান্তরের সময় কার্ডে তিনি টিপসই দেননি। হস্তান্তরের সময় ডিলার সেপ্টেম্বর মাসে চাল বিতরণ দেখিয়েছেন এটা তিনি বুঝতে পারেননি। গ্রহীতার ঘরে শুধু লেখা রয়েছে নিমাই।

অন্যদিকে গত ৪ অক্টোবর ৩০ কেজি চাল দিয়ে কার্ডের গ্রহীতার ঘরে নিমাই এর টিপসই নিয়েছেন। গ্রামের মন্ডল কার্ডটা চেক করতে গিয়ে ডিলারের জালিয়াতি ধরতে পেরেছেন।

এই গ্রামের মন্ডল জুয়েল সরেন বাবু জানান, গোগ্রাম ইউনিয়নের দুই জন ডিলারের একজন মিজানুর রহমান সোলাব ৯ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি। তার ওয়ার্ডের কার্ডধারীদের গত ২৭ সেপ্টেম্বর কার্ড হস্তান্তর করা হয়েছে। কার্ড হস্তান্তরের সময় কার্ডগুলিতে সেপ্টেম্বর মাসের চাল উত্তোলন দেখানো হয়েছে।

গত ৪ অক্টোবর আদিবাসীদের কার্ড প্রতি ৩০ কেজি চাল দিয়ে কার্ডে টিপসই নিয়েছেন। কিন্তু আদিবাসীদের কার্ডগুলি চেক করতে গিয়ে ডিলারের জালিয়াতি ধরতে পারেন। কারণ সেপ্টেম্বর মাসে কোন কার্ডধারীকে চালই দেওয়া হয়নি।

আদিবাসী গ্রামের মন্ডল জুয়েল সরেন বাবু আরও বলেন, আদিবাসীরা পড়ালেখা কিছুই জানেন না। কিন্তু তাদের কার্ডগুলিতে সেপ্টেম্বর মাসের চাল বিতরণ দেখিয়ে কার্ডে গ্রহীতার ঘরে স্বাক্ষর করা দেখানো হয়েছে।

গোদাগাড়ী উপজেলার গোগ্রাম ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাসুদ রানা নিজেও একটি কার্ড পেয়েছেন। তাকেও একইভাবে প্রতারণা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। মাসুদ জানান, গোগ্রাম ইউনিয়নে হতদরিদ্র মানুষের এই কার্ডের সংখ্যা ১ হাজার ৬৩৫টি। এই ইউনিয়নের এক মাসের বরাদ্দ প্রায় ৪৯ টন।

এদিকে জালিয়াতি ও দুর্নীতির অভিযোগ প্রসঙ্গে দুই ডিলার তৌহিদুল ইসলাম ও মিজানুর রহমান অস্বীকার করে বলেন, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর দুই মাসেরই চাল তাদের দেওয়া হয়েছে।

তবে এক মাসে স্বাক্ষর ও অন্যমাসে টিপসই কেন মোবাইল ফোনে জানতে চাইলে দুই ডিলার অনিয়মের বিষয়টি আংশিকভাবে স্বীকার করেছেন। তারা বলেন, তাড়াহুড়ার কারণে কিছুটা অনিয়ম হয়েছে। তবে তা ইচ্ছাকৃত নয়।

এ ব্যাপারে গোদাগাড়ী উপজেলা নির্বাহী অফিসার জাহিদ নেওয়াজ বলেন, গোগ্রাম ইউনিয়নে চাল বিতরণে ডিলারের জালিয়াতির মৌখিক অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রমাণ পেলে ডিলারের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

রাজশাহীর জেলা প্রশাসক কাজী আশরাফ উদ্দীন বলেন, দশ টাকার চাল বিতরণ কর্মসূচি অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে সফল করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রশাসন ‘জিরো টলারেন্স’ এ রয়েছে। কেউ যদি চাল বিতরণে অনিয়ম করে তাহলে ছাড় দেওয়া হবে না।

/ এইচকে/