বড়াল নদীর কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার কালুহাটি গ্রাম। এখানে প্রবেশ করলেই চোখে পড়ে জুতা-স্যান্ডেল তৈরির বিভিন্ন কারখানার সাইনবোর্ড। আশপাশের সবার কাছে গ্রামটি ‘পাদুকা পল্লী’ নামেই পরিচিত। তবে বাজারজাতকরণ, সহজ শর্তে ঋণ না পাওয়া, সঠিক প্রশিক্ষণের অভাবসহ নানা কারণে স্থানীয় গণ্ডি থেকে বের হতে পারছে না সম্ভাবনাময় এই শিল্প। কারখানা মালিকরাও বলছেন, জুতা তৈরিতে দক্ষ হলেও মূলত পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা না থাকার কারণেই বিদেশে রফতানি করা দূরে থাক, দেশের বিভিন্ন জায়গায় পণ্য পাঠাতে পারছেন না তারা।
১৯৮০ সালে কালুহাটি পাদুকা পল্লী গড়ে তোলার প্রথম পরিকল্পনা করেছিলেন সুবেদার আমজাদ হোসেন। চাকরি সূত্রে বিভিন্ন এলাকায় ঘোরাঘুরির অভিজ্ঞতা পুঁজি করে পথে নামেন তিনি। এরপর জুতা তৈরির প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য আমিরুল, বারেক, কাশেম, দেলশাদ ও আমজাদ হোসেন ভৈরব যান। সেখানে প্রশিক্ষণ শেষ করে কালুহাটে ফিরে দেলশাদ ও আমজাদ হোসেন দুজনের মালিকানায় ‘মুক্তা সু’ নামে একটি কারখানা চালু করেন।
বর্তমানে ছোট-বড় ৫০টি পাদুকা তৈরি করার কারখানা গড়ে উঠেছে কালুহাটিতে। নিউ মান্নান, ন্যাশনাল, ডায়মন্ড, শ্রাবণী, পায়ে পায়ে, শিশির, মেঘলা, রানা, সিয়াম, রাসেল, মডার্ন, দেশ, এমএফ, নাজ ওয়ান, রবিনসহ নানা নামের সু ফ্যাক্টরিতে কাজ করছেন ৫ হাজার শ্রমিক। এছাড়া গৃহস্থালির কাজের পাশাপাশি আরও ২ হাজার লোক জুতা তৈরির কাজ করেন। শুধু তাই নয়, পড়ালেখার পাশাপাশি অনেক ছাত্রও এসব কারখানায় কাজ করেন।
দীর্ঘদিন ধরে এই পাদুকা পল্লী বিচ্ছিন্নভাবেই তৈরি পণ্য বাজারজাত করছিল। এতে নিজেদের সমস্যার কথা বলতে কোনও ব্যক্তি বা সংগঠন ছিল না। তাই নিজেদের দাবি আদায়ের জন্য সবাইকে এক ছাদের নিচে নিয়ে আসার জন্য ২০১০ সালে তাদের একটি সমিতি গঠন করার নির্দেশ দেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম।
সম্প্রতি বিশ্ববিখ্যাত ব্র্যান্ড হুগো বসের জুতায় ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ দেখে নিজের ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে এই কালুহাটির পাদুকা পল্লীর সাফলতাকে আরও বড় কিছু করার স্বপ্নের কথা লিখেছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও স্থানীয় সাংসদ শাহরিয়ার আলম।
প্রতিমন্ত্রী তার ফেসবুক পেজে লিখেছিলেন, ‘বাংলাদেশ পৃথিবীর ২য় বৃহত্তম পোশাক তৈরি এবং রফতানিকারক দেশ, এটা পুরনো খবর। জাহাজ রফতানি করে, এটাও পুরানো খবর। যুক্তরাষ্ট্রে ওষুধ রফতানি করে, এটাও পুরানো খবর।
কিন্তু আমি নিজের চোখে যা দেখলাম আজকে, আনন্দে ঘুম হারাম হয়ে গেলো। বিশ্ব বিখ্যাত ব্র্যান্ড HUGO BOSS এর দোকানে বিক্রি হচ্ছে MADE IN BANGLADESH জুতা। তাও আবার কোনও নিয়মিত পণ্য বা টাইপ না। লিমিটেড এডিশনের AMZ Mercedes Benz রেঞ্জের জুতা!
আমি এখন স্বপ্ন দেখি চারঘাটের বড়াল পাড়ের কালুহাটির পাদুকা পল্লীর সফলতাকে পুঁজি করে আরও বড় কিছু করার। অসম্ভব মনে হচ্ছে ?
১৬ কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবানা!!!
বাংলাদেশ বিশ্বকে অবাক করে যাচ্ছে, অবাক করে যাবে।’
সমিতির বর্তমান সভাপতি আব্দুল মান্নান বলেন, ‘শাহরিয়ার আলম আমাদের তিনটি মাইক্রোবাস ভাড়া করে বাটা, এপেক্স, আড়ংসহ বিভিন্ন কারখানা পরিদর্শন করিয়েছেন। এমনকি ঢাকায় একটি উন্নতমানের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করে দেন। সেই সঙ্গে কালুহাটিতে ১০টি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন।’
তিনি বলেন, ‘বিদেশে আমাদের এখনকার জুতা-স্যান্ডেল রফতানির জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। সেই সঙ্গে শিক্ষিত মালিকেরও প্রয়োজন। তাহলেই সম্ভব হবে কালুহাটির পাদুকা পাল্লীর পণ্য বিদেশে রফতানি করা।’
বর্তমানে কালুহাটির পাদুকা পল্লীর জুতা-স্যান্ডেল দেশের রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, কুষ্টিয়া, সিরাজগঞ্জ, পাবনা ও বগুড়া জেলার বিভিন্ন দোকানে বিক্রি হয়।
কানিজ সুজ কারখানার মালিক কামরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের এখনকার জুতা-স্যান্ডেল ভালো মানের ম্যাটেরিয়ালস দিয়ে তৈরি করা হয়। সেই সঙ্গে অন্যদের তুলনায় দামও কম। ঠিকমত বাজারজাত করতে পারলে দেশের অন্য এলাকায়ও আমাদের পণ্যের চাহিদা বাড়বে।’
ন্যাশনাল সুজ ফ্যাক্টারির মালিক মুকসেল আলী বলেন, ‘আমরা ঢাকার বঙ্গবাজার, গুলিস্তান, সিদ্দিক বাজার থেকে কাঁচামাল ক্রয় করি। সেই সঙ্গে এখনকার শ্রমিকদের মুজরি কম। তাই আমরা কম মূল্যে হওয়ায় কালুহাটি পাদুকা পল্লী থেকে মাসে গড়ে ৩০ লাখ টাকার জুতা-স্যান্ডেল পাইকারি বিক্রয় করতে পারি।’
রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের চারঘাটের সরদহ শাখার ট্রেনিং অফিসার নয়া রহমান বলেন, ‘কালুহাটি গ্রামে জুতা-স্যান্ডেল তৈরির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কারখানা গড়ে উঠেছে। যা দেশের জিডিপিতে অবদান রাখছে ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়তা করছে। এ শিল্পের সমস্যা ও সম্ভাবনা দুটোই রয়েছে। তবে কারিগরি জ্ঞান থাকার পরও বাজারজাতকরণ পদ্ধতি না জানার কারণে অনেক উদ্যোক্তা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। যথাযথ শিক্ষার অভাবে সঠিকভাবে ঋণ সহায়তাও কাজে লাগাতে পারছেন না তারা। উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণের সুব্যবস্থা করা হলে কালুহাটির শিল্পের দ্রুত বিকাশ সম্ভব হবে।’
/এমও/এসটি/