লিচুর ফলন ভালো, বিক্রি নিয়ে শঙ্কায় চাষিরা

লিচু বাগান



‘লিচুর রাজধানী’ হিসেবে পরিচিত পাবনার ঈশ্বরদীর বাজারে উঠতে শুরু করেছে আঁটির লিচু। এক সপ্তাহ পরে উঠতে শুরু করবে বোম্বাই লিচু। আগের বছরগুলোর তুলনায় এবারে লিচুর ফলন ভালো হলেও, মোকামগুলোয় পাইকারি আর ব্যবসায়ীদের নেই কোনও কর্ম মুখরতা। করোনা পরিস্থিতির কারণে আগাম টাকা দিয়ে পাইকাররা লিচু বায়না করতে এখনও আসা শুরু করেনি। উল্টো বায়না করা বাগান ফেরত দিয়ে টাকা নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ফলে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে লিচু উৎপাদনকারী সহস্রাধিক চাষি ও ব্যবসায়ীরা দুশ্চিন্তায় আছেন লিচু বিক্রি করা নিয়ে। 

ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি অফিসার আব্দুল লতিফ বলেন, কীভাবে এই পরিস্থিতিতে চাষি ও ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা করা যায় তা নিয়ে মন্ত্রী, এমপিসহ ঊর্ধ্বতন কর্তকর্তাদের সঙ্গে কথা চলছে।

লিচু
লিচু বাগান মালিকরা জানান, অন্যান্য বছরগুলোর তুলনায় এবার ফলন ভালো হলেও ক্রেতা নেই। লিচুর ফুল আসা শুরুর পর অনেক বাগান কেনাবেচা হয়েছে। তবে লকডাউন শুরুর পর লিচু বিক্রির অনিশ্চয়তা থেকে বাগান দিয়ে আগাম টাকা ফেরত নিয়েছেন অনেক ব্যবসায়ী। বাগান ফেরত পেয়ে বিপাকে পড়েছেন মালিকরা। বাগান আগাম নেওয়া ব্যবসায়ীরাই লিচুর বাজারজাতকরণ সম্পর্কে ভালো জানেন। তাই বিপুল পরিমাণ লিচু বিক্রি নিয়ে মালিকদের বেগ পেতে হবে। এছাড়া প্রত্যেক চাষি এবার লিচুর কাঙ্ক্ষিত দামে বিক্রি নিয়ে শঙ্কায় আছেন। 
উপজেলার চাঁদপুর চরের লিচু চাষি আলম হোসেম বলেন, ‘প্রায় ১০ বিঘার ৮টা বাগান ইজারা নিয়েছি। সেখানে ১০০টির মতো লিচু গাছ রয়েছে। বাগান প্রতি ইজারা ব্যয় ও কীটনাশকসহ আনুষাঙ্গিক ব্যয় বাবদ ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। প্রতিবারের মতো এবারও ফলন ভালো। এরইমধ্যে কিছু গাছে লিচু পাকতে শুরু করেছে। কিন্তু এবার ঢাকার পাইকাররা আসবে কিনা, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছি।’ 
সলিমপুরের লিচু ব্যবসায়ী ফয়সাল আহমেদ বলেন, ‘আমাদের লিচুর বাজার রাজধানী ঢাকাসহ অন্যান্য জেলার ক্রেতা নির্ভর। করোনার কারণে অন্য জেলা থেকে মহাজন, ব্যাপারী ও ফঁড়িয়ারা এবার ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না। তাই আমরাও বাগান নেওয়া বা চাষিদের সঙ্গে কোনও চুক্তিতে আসতে পারছি না। এবার প্রায় বাগানেই ফলন ভালো হওয়ায় ন্যায্যমূল্য নিয়েও শঙ্কা রয়েছে।’ 
লিচু চাষি আশরাফুল ইসলাম বলেন, লকডাউনের আগে অগ্রিম টাকা দিয়ে এক পাইকার তাদের একটি বড় বাগান নেন। তবে লকডাউনের কারণে অগ্রিম অর্থ ফেরত নিয়ে গেছেন। এখন বাগান ভর্তি লিচু নিয়ে বিপদে পড়েছি। যারা নিয়মিত ব্যবসায়ী তারা জানেন লিচুর বাজার সম্পর্কে, যা আমার জানার কথা নয়। এখন লিচু কীভাবে বিক্রি করবো সেটাই ভাবছি। 

লিচু বাগান
কামালপুর চর এলাকার চাষি সাকিব আল হাসান সোহেল জানান, তাদের তিন বিঘার বাগানে এবার ভালোই লিচু ধরেছে। এখন পর্যন্ত অর্ধ লক্ষাধিক টাকা খরচ করেছি কীটনাশক ও আনুষাঙ্গিক ব্যয় বাবদ। ঝড়-বাদলে লিচুর ক্ষতি না হলে শেষ পর্যন্ত ভালো লিচু ফলন হবে। কিন্ত লকডাউন পরিস্থিতিতে কোনও পাইকার লিচু কিনতে না এলে লোকসানে স্থানীয় বাজারে লিচু বিক্রি করতে হবে। 
মানিকনগরের লিচু চাষি বাদশাহ প্রামাণিক বললেন, ‘লিচু বাজারজাতকরণ নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। এমনিতেও পচনশীল হওয়ায় লিচুতে সবসময় ঝুঁকি থাকে, এবার তা অন্যবারের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। লিচু আহরণ ও বাজারজাতকরণের সঙ্গে জড়িত ১০ হাজার শ্রমিক কর্মচারী বেকার হয়ে পড়েছেন। লিচুর কোটি টাকার ব্যবসা এবার অনিশ্চিত।’ 
ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, এখানে তিন হাজার দুইশ হেক্টর জমিতে লিচুর বাণিজ্যিক বাগান রয়েছে। গাছের সংখ্যা তিন লাখের ওপর। এর মধ্যে দুই লাখ গাছের বয়স ১৫ বছরের বেশি। এ ছাড়া সারা উপজেলাতেই বসতবাড়ির আশপাশেও রয়েছে প্রচুর লিচুগাছ। লিচু চাষ লাভজনক হওয়ায় প্রতিবছরই বাগানের সংখ্যা বাড়ছে। তাদের হিসাবে বড় গাছগুলোতে এবার নিম্নে ১০ হাজার, ঊর্ধ্বে ২৫ হাজার পর্যন্ত লিচু ধরেছে। অপেক্ষাকৃত ছোট গাছে লিচু এসেছে তিন থেকে পাঁচ হাজার পর্যন্ত। বড় গাছে গড়ে ১০ হাজার ও ছোট গাছে ৩ হাজার করে ধরলে এবার লিচুর সংখ্যা প্রায় ২৩০ কোটি। পাইকারিতে গড়ে প্রতি লিচুর দাম দেড় টাকা ধরা হলেও দাম হয় ৩৪৫ কোটি টাকা। এর সঙ্গে যোগ হবে বসতবাড়ির আশপাশের গাছের লিচুর দাম।

লিচু বাগান
ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল লতিফ জানান, আঁটির লিচু বাজারে উঠছে। বোম্বে লিচু উঠতে আরও এক সপ্তাহ সময় লাগবে। করোনা পরিস্থির কারণে পণ্যবাহী গাড়ির ভাড়া বেশি হওয়ায় এবার লিচুর পাইকার ব্যবসায়ীরা এই অঞ্চলে লিচু ক্রয় করতে আগ্রহ একদমই কম দেখাচ্ছে। তারা এখনও তেমন একটা এ অঞ্চলে আসা শুরু করেন নাই। আমরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করে চলেছি। তাদের পুরো পরিস্থিতি অবগত করেছি।