জেলাটিতে এখনও চলছে কিডনির রমরমা ব্যবসা

জয়পুরহাটের কালাই ও পাঁচবিবি উপজেলায় গরিব ও অসহায় মানুষদের প্রলুব্ধ করে ও ফাঁদে ফেলে কিডনি বিক্রিতে বাধ্য করছে দালাল চক্র। একসময় যারা কিডনি বিক্রি করেছেন তারাই এখন এই দালাল চক্র পরিচালনা করছেন। অসহায় মানুষদের প্রথমে টাকা ধার দিয়ে পরে তা ফেরত চাইতে গিয়ে না পেলে তাদের কিডনি বিক্রির ফাঁদে ফেলছে চক্রটি। দুটি পৃথক অভিযানে এই দালাল চক্রের ৯ জনকে গ্রেফতার করেছে জয়পুরহাট জেলা গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) পুলিশ। শুক্রবার (১০ জুন) জয়পুরহাট পুলিশ সুপার কনফারেন্স কক্ষে এক ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান পুলিশ সুপার মাছুম আহাম্মদ ভূঞা।

এদের ১৩ ও ৩০ মে দুটি পৃথক অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতার দালাল চক্রের ৯ জন হলেন, জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার মোসলেমগঞ্জ টাকাহুত গ্রামের মৃত বেলায়েত হোসেন সরকারের ছেলে মো. আব্দুল গোফফার সরকার (৪৫), জয়পুর বহুতি গ্রামের আব্দুস সাত্তারের ছেলে নুর আফতাব (৩২), থল গ্রামের মৃত সিরাজের ছেলে মো. সাহারুল (৩৮), উলিপুর গ্রামের ফরিদুল ইসলামের ছেলে ফরহাদ হোসেন ওরফে চপল (৩১), জয়পুর বহুতী গ্রামের মৃত মফিজ উদ্দিনের ছেলে মোশাররফ হোসেন (৫৪), ভেরেন্ডি গ্রামের জাহান আলমের ছেলে শাহারুল ইসলাম (৩৫), জয়পুর বহুতী গ্রামের মো. মোকাররম (৫৪), দুর্গাপুর গ্রামের মৃত বছিরউদ্দিনের ছেলে সাইদুল ফকির (৪৫) ও পাঁচবিবি উপজেলার গোড়না আবাসন এলাকার মৃত আবদুস সাত্তারের ছেলে সাদ্দাম হোসেন (৪০)।

গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে শাহারুল ইসলাম ২০০৯ সালে, মোকাররম ২০০৬ সালে, সাইদুল ফকির ২০১৬ সালে তাদের কিডনি বিক্রি করেন। এ ছাড়া ফরহাদ হোসেন, সাদ্দামরা কিডনি বিক্রির জন্য ভারতে গেলেও তারা ভয়ে কৌশলে পালিয়ে আসেন। পরে তারা চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।

এই দালাল চক্রের মাধ্যমে কিডনি বিক্রিকারীদের একজন হলেন মো. মেহেরুল ইসলাম (৪০)। তিনি কালাই উপজেলার ভেরেন্ডি এলাকার জাহান আলমের ছেলে। দুই লাখ টাকার বিনিময়ে ২০১০ সালে বারডেম হাসপাতালে গিয়ে নিজের কিডনি দিয়ে আসেন তিনি। এই চক্রের সাত্তার নামে এক দালালের মাধ্যমে কিডনি বিক্রি করেন। পরে তার পরিবারের চার সদস্যের সবাই কিডনি বিক্রি করেছেন। জাহিদ নামে আরেক দালালের মাধ্যমে ২০১৮ সালে ভারতে গিয়ে কিডনি বিক্রি করেন কালাই উপজেলার উলিপুরের ফরহাদ হোসেনের স্ত্রী সোনিয়া আক্তার (২৪)। তিনি কিডনির বিনিময়ে পেয়েছেন তিন লাখ ৬০ হাজার টাকা।

কালাইয়ে ভেরেন্ডি এলাকার রেজাউল করিম (৪৫) এক লাখ টাকার বিনিময়ে ভারতে গিয়ে নিজের কিডনি দিয়ে আসেন ২০১৪ সালে। একই উপজেলার কাশিপুরের আবেদ আলী (৪৫) দুই লাখ ২৫ হাজার টাকার বিনিময়ে ২০১৫ সালে ভারতে গিয়ে নিজের কিডনি বিক্রি করেন। পাঁচবিবির আহসান হাবিব (২৩) ২০২১ সালে দালাল চক্রের মাধ্যমে কিডনি বিক্রি করতে ভারতে গেলেও ভয়ে পালিয়ে আসেন। এ ছাড়া কালাইয়ের জগন্নাথপুরের শ্রী বিমল চন্দ্র রবিদাস (২৫) ২০২২ সালে ভারতে কিডনি বিক্রি করতে যাওয়ার আগে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। তার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে দালাল চক্র তাকে প্রথমে পাঁচ হাজার টাকা ধার হিসেবে দেয়। পরে টাকা ফেরত চাইতে গিয়ে না পেয়ে কিডনি বিক্রিতে বাধ্য করে।

পুলিশ সুপার মাছুম আহাম্মদ ভূঞা বলেন, ‘দালালরা অসহায় ও গরিবদের অভাব-অনটনের সুযোগ নিয়ে তাদের প্রথমে ৫ থেকে ২০ হাজার টাকা ধার বা সুদের ওপর দেয়। কিছু দিন পর পরিকল্পনা মতো টাকা ফেরত চায়। ফেরত দিতে না পারলে কিডনি বিক্রির জন্য বাধ্য করতো। এ কাজে অসাধু চিকিৎসকরা সহযোগিতা করতেন। তাদের মাধ্যমে ভুক্তভোগীদের শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেশের ভেতরে বা দেশের বাইরে পাঠিয়ে কিডনি অপসারণ করা হতো। পরে ভুক্তভোগীদের চিকিৎসা শেষে হাতে এক থেকে দুই লাখ টাকা ধরিয়ে দিয়ে দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হতো।’

তিনি আরও বলেন, ‘সম্প্রতি কালাই থানা এলাকা থেকে কয়েকজন নিখোঁজ হন। এখন তারা কালাই এলাকার কিডনি চক্রের প্রধান দলাল কাওছার ও সাত্তারের মাধ্যমে দুবাই ও ভারতে অবস্থান করছেন। জানতে পেরেছি, সাম্প্রতিককালে কালাই থানা এলাকার পাশাপাশি পাঁচবিবি থানাতেও কিডনি বেচাকেনা শুরু হয়েছে।’

ব্রিফিংয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) ফারজানা হোসেন, অতিরিক্ত পুলিস সুপার (সদর) মোসফেকুর রহমান, সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (পাঁচবিবি সার্কেল) ইসতিয়াক আলম ও জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ওসি শাহেদ আলী মামুন উপস্থিত ছিলেন।

প্রসঙ্গত, ২০১১ থেকে ২০১৪ সালে জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার আহমেদাবাদ ইউনিয়নের রাঘবপুর, বোড়াই, নওপাড়া, হারুঞ্জা ও বালাইট গ্রাম; মাত্রাই ইউনিয়নের উলিপুর, সাঁতার, ভাউজাপাতার, শিবসমুদ্র, অনিহার, ভেরেন্ডি, কুসুমসাড়া, ছত্রগ্রাম, পাইকশ্বর ও ইন্দাহার গ্রাম; উদয়পুর ইউনিয়নের বহুতি, মোহাইল, বাগইল, দুধাইল, জয়পুর বহুতি, নওয়ানা, দুর্গাপুর, উত্তর তেলিহার, ভুষা, কাশিপুর ও বিনইল গ্রামসহ কয়েক গ্রামের অসহায় ও গরিব মানুষ অভাবে পড়ে অর্থের লোভে কিডনি বিক্রি করেছিলেন।

আজও এসব এলাকার লোকজন গোপনে কিডনি বিক্রি করে যাচ্ছেন। সম্প্রতি তা বৃদ্ধি পাওয়ায় পুলিশ ও র‍্যাব অভিযান চালিয়ে দালালদের গ্রেফতার করছে। এ পর্যন্ত দালাল চক্রের সদস্যদের বিরুদ্ধে ১৪টি মামলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলার পুলিশ সুপার।