খাসি-ভেড়ার চামড়া প্রতি পিস ৫ টাকা

বগুড়ায় বিগত কয়েক বছরের মতো এবারও কোরবানির পশুর চামড়ার বাজারে ধস নেমেছে। শহরের বিভিন্ন স্থানে চামড়া বিক্রি হলেও দাম ছিল না। গ্রামের অনেক এলাকায় চামড়া বিক্রি হয়নি। খাসি ও ভেড়ার চামড়া পাঁচ টাকাতেও বিক্রি হয়েছে। অনেক কোরবানিদাতা চামড়া রাস্তার পাশে ফেলে দিয়েছেন। আবার কেউ কেউ অবিক্রীত চামড়া আশপাশের মসজিদের খাদেম ও মাদ্রাসায় দান করে দিয়েছেন।

কোরবানিদাতারা ‘গরিবের হক’ চামড়ার সঠিক মূল্য পেতে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কঠোর নজরদারি প্রত্যাশা করেছেন।

পবিত্র ঈদুল আজহার দিন শনিবার (৭ জুন) দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত শহরের বাদুড়তলা, চকসুত্রাপুর, ইয়াকুবিয়া স্কুল মোড়সহ বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গরুর চামড়া আকারভেদে ৩০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৮০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। তবে বেশি বিক্রি হয়েছে, ৫০০ থেকে ৭০০ টাকার মধ্যে। খাসির চামড়া সর্বোচ্চ ৩০ টাকা থেকে সর্বনিম্ন পাঁচ টাকা পিস বিক্রি হয়। তবে বেশিরভাগ বিক্রি হয়েছে ৯-১০ টাকা পিস হিসেবে। অনেক এলাকায় মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ছাগল ও ভেড়ার চামড়া কিনতে রাজি না হওয়ায় অনেক কোরবানিদাতা চামড়া রাস্তার পাশে বা ময়লার ভাগাড়ে ফেলে দিয়েছেন।

বগুড়ার গাবতলীর লাঠিগঞ্জ গ্রামের মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী সায়েদ আলী জানান, তিনি এলাকা থেকে কিছু গরু ও খাসির চামড়া কেনেন। লাভের আশায় চামড়াগুলো অটোরিকশা-ভ্যানে তুলে বগুড়া শহরের বাদুড়তলায় বিক্রি করতে আসেন। দুপুর পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত দাম না পাওয়ায় বিক্রি করতে পারেননি। যে দোকানে যান তারা কম দাম বলেন। আর খাসির চামড়া নেয়নি। বিকালের দিকে যে দামে বিক্রি করেছেন, তাতে তার পরিশ্রম ও ভ্যানের ভাড়া ওঠেনি।

একই ধরনের মন্তব্য করেছেন বগুড়া সদরের এরুলিয়া, দশটিকা, ঘোড়াধাপ, হাজরাদীঘি, গোকুল, মহিষবাথান, লাহিড়িপাড়া, শেকেরকোলা, কাহালুর মালঞ্চা, গাবতলীর রামেশ্বরপুর, শাজাহানপুরের সাজাপুর এলাকা থেকে কোরবানির গরু, খাসি ও ভেড়ার চামড়া বিক্রি করতে আসা মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।

তারা জানান, বিগত কয়েক বছরের মতো সরকার নির্ধারিত দরে চামড়া বিক্রি হয়নি। গত বছরের চেয়ে এবারের অবস্থা আরো শোচনীয়। পরিস্থিতি এমনটা হতে পারে এ আশঙ্কায় অনেকে এ বছর চামড়া কেনাবেচা থেকে বিরত থাকেন। আর তাদের মতো যারা চামড়া কেনাবেচা করেন তারা ধরা খেয়েছেন। অধিকাংশ মৌসুমি ব্যবসায়ী এবার লাভের মুখ দেখতে পাননি। তাদের অনেকে চামড়া নিয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে থাকেন। একপর্যায়ে কেনা দাম বা কিছুটা ক্ষতি স্বীকার করে চামড়া বিক্রি করেছেন।

বগুড়া শহরের সুলতানগঞ্জপাড়ার বাসিন্দা একটি বেসরকারি কলেজের অধ্যক্ষ সুলতান মাহমুদ জানান, প্রতিবছর পাড়ার মধ্যে মৌসুমি ক্রেতারা এসে চামড়া কিনে নিয়ে যান। এ বছর তিনি মহাস্থান হাট থেকে এক লাখ ২২ হাজার টাকায় একটি ষাঁড় গরু কেনেন। প্রতিবেশী প্রকৌশলী রতন এক লাখ ৮০ হাজার টাকায় এবং ব্যবসায়ী কাজল চৌধুরী এক লাখ ১০ হাজার টাকায় ষাঁড় গরু কেনেন। দুপুরে ২/৩ জন ক্রেতা এসে সর্বোচ্চ ৮৫০ টাকা দাম বলে গেছেন। তখন তাদের চামড়া দেননি। আসরের নামাজের পর আর কোনও ক্রেতা চামড়া নিতে আসেনি।

অধ্যক্ষ সুলতান মাহমুদ আরও জানান, এলাকায় বিক্রি না হওয়ায় বাধ্য হয়ে তিনি ও তার প্রতিবেশীরা গরুর চামড়া অটোরিকশায় তুলে শহরের বাদুড়তলায় এক আত্মীয় ব্যবসায়ীর কাছে নিয়ে যান। আত্মীয় হওয়ার সুবাদে তিনটি চামড়ার দাম তিন হাজার টাকা পেয়েছেন।

তিনি জানান, অনেক কোরবানিদাতা চামড়া বিক্রি করতে পারেননি। মাদ্রাসায় বা দরিদ্র মানুষকে দান করে দিয়েছেন।

বগুড়া শহরের বাদুড়তলা এলাকার গণমাধ্যমকর্মী রেজাউল হক জানান, বিগত দিনের মতো চামড়ার বাজার দর কম হওয়ায় গরিবরা তাদের হক থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। চামড়ার মূল্য বৃদ্ধিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কঠোর নজরদারি প্রয়োজন।

বগুড়া সদর উপজেলার ঘোলাগাড়ি গ্রামের কোরবানিদাতা আবদুল মজিদ জানান, তিনি কুরবানির জন্য স্থানীয় হাট থেকে ৯৬ হাজার টাকায় ষাঁড় কেনেন। সন্ধ্যা পর্যন্ত ওই গরুর চামড়া বিক্রি করতে পারেননি। মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কেউ এলাকায় না আসায় তার মতো অনেকের চামড়া বিক্রি হয়নি।

বগুড়া শহরের চামড়া ব্যবসায়ী জুয়েল রানা বলেন, খরচ বাড়ছে কিন্তু দাম কমছে। চামড়া সংরক্ষণের খরচ, পরিবহন, শ্রমিক খরচ বেড়েই চলেছে। তাই সব খরচ মিলিয়ে ব্যবসা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। বছরের কোরবানির ঈদের সময় তারা ব্যবসা করে থাকেন। এবার লাভ করা দূরে থাক উল্টো ক্ষতিতে পড়েছেন। তিনি চামড়ার বাজারের এ বেহাল দশার জন্য মধ্যস্বত্বভোগী দৌরাত্ম্যকে দায়ী করেন।

অপর ব্যবসায়ী সিরাজুল ইসলাম বলেন, সরকার শুধু চামড়ার দাম নির্ধারণ করেই তাদের দায়িত্ব শেষ করে। তারা বাজারে কোনও নজরদারি করে না। কার্যকর নজরদারি না থাকলে প্রতিবছরই এভাবে চামড়ার বাজারে ধস নামবে। এ ব্যবসা ধ্বংস হয়ে যাবে।

বগুড়া জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সহসভাপতি ফজলুর রহমান জানান, সরকার চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দিলেও বিদেশে রফতানি না হওয়া, লবণ, পরিবহণ, মজুত ও শ্রমিক মূল্য বেশি হওয়ায় ব্যবসার মন্দাভাব দেখা দিয়েছে। ফলে তাদের সমিতির ২৫৬ জন সদস্যের অনেকে এখন এ ব্যবসায় নেই। কেউ কেউ পুঁজি হারিয়ে রিকশা চালাচ্ছেন। ঢাকার বিভিন্ন চামড়া ব্যবসায়ী ও লেদার কোম্পানির কাছে তাদের ১০-১৫ জন ব্যবসায়ীর অন্তত ১৩ কোটি টাকা বকেয়া পাওনা রয়েছে। এর মধ্যে শুধু তার নিজের ঢাকার আরাফাত লেদারের কাছে এক কোটি ৫৬ লাখ, জাকির লেদারের কাছে ৪০ লাখ ও সালমা লেদারের কাছে ২৪ লাখ টাকা পাওনা রয়েছে। এ পাওনা টাকার ব্যাপারে তাদের শক্ত কোনও প্রমাণ নেই। তাই ঢাকার মহাজনরা বকেয়া পরিশোধে আগ্রহী নন। তারা শুধু বলেন, মাল পাঠান বিল পরিশোধ করবো। মাল (চামড়া) পাঠানোর পর কিছু টাকা দিলেও বকেয়া দিতে চান না।

তিনি আরও বলেন, দীর্ঘদিন বকেয়া টাকা না পাওয়ায় তিনি অন্য ব্যবসায়ীরা দুর্বল হয়ে পড়েছেন। এ বছর তারা আকার ও মানভেদে ২০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৯০০ টাকায় গরুর চামড়া কিনেছেন। ছাগলের চামড়া কিনেছেন, ১৫ টাকা থেকে ২৫ টাকায়। অন্য ব্যবসায়ীরা চামড়ার বাজার ধসের জন্য মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যকে দায়ী করলেও ফজলুর রহমান এ ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করেননি।