স্থানীয়ভাবে বৈরালি বা বৈরালী নামে পরিচিত এই মাছটিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ডাকা হয় বোরালি নামে। বই-পত্রেও এটি বোরালি নামে চিহ্নিত। বোরালি মাছের বৈজ্ঞানিক নাম-বারিলিয়াস বারিলা (Barilius Barila)। এটি মূলত স্বচ্ছ পানির মাছ। পাহাড় বেয়ে নেমে আসা নদী তিস্তা-ধরলায় এই মাছ পাওয়া যায়। তিস্তা-ধরলার ধারা নামায় ব্রহ্মপুত্র নদীতেও এই মাছ কিছু পরিমাণে মেলে। বাংলাদেশে কেবল উত্তরের জেলা লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও কুড়িগ্রামেই এই মাছ পাওয়া গেলেও বৈরালি বা বোরালি মাছের বিস্তার ভারত, নেপাল, মিয়ানমারের পাহাড়ি নদীগুলো জুড়েই।
বোরালি মাছ সর্বোচ্চ ৬-৭ ইঞ্চি বা ১০ সেন্টিমিটার লম্বা এবং প্রস্থে প্রায় ১ ইঞ্চি আকারের হয়ে থাকে। রূপালী রঙের মাছটির গায়ে ছোট ছোট আঁশ, পিঠের রং হালকা মেটে। পেটের নিচে হলুদ দাগ থাকে। মাছটির পুঁটি মাছের মতো কাঁটা থাকলেও তা খুবই নরম। বৈরালি মাছ গ্রীষ্মকালীন সময়ে বংশ বিস্তার করে থাকে।
জেলেরা জানিয়েছেন, ইলিশ মাছের মতোই বৈরালি মাছ জালে ধরার পড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা যায়। আবার দ্রুত বরফ দিতে না পারলে বেশিক্ষণ সংরক্ষণও করা যায় না।
স্থানীয় একজন গৃহিণী তহুরা ইসলাম জানান, বৈরালি খুবই সুস্বাদু মাছ। সাধারণত বৈরালি মাছ ভুনা করে রান্না করা হয়। এছাড়াও কেউ কেউ আলু, পটল, ঝিঁঙ্গার মিশেল দিয়ে হালকা ভাজি করে। এছাড়াও আলুর ডালের মধ্যেও বৈরালি মাছ দিয়ে রান্না করেন অনেকে। এর স্বাদের তুলনা হয় না।
এলাকার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মাহবুব রানা ও মাহমুদুন্নবী পামেল জানান, বৈরালি মাছ এমনই সুস্বাদু যে রংপুর এলাকার বাইরের কোনও অতিথি বাসায় এলে এই মাছটি খাওয়ার জন্য আবদার করে থাকেন। আমরাও তাকে আপ্যায়ন করার জন্য চেষ্টা করি। কিন্তু অনেক সময় দিনের পর দিন বাজারে ঘুরেও বৈরালি মাছের দেখা মেলে না।
বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে জানা গেছে, তিস্তা ও ধরলা নদীর উজানে ভারত বাঁধ নির্মাণ করে সেচ কাজের জন্য এক তরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে নেওয়ায় ভাটিতে তথা বাংলাদেশ অংশে তিস্তা ও ধরলায় প্রকট আকারে পানি সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ফলে এই দুই নদী থেকে বৈরালি মাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও জলজ প্রাণির বিলুপ্তি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
তিস্তা ব্যারাজের কাছে অবস্থিত গড্ডিমারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা আতিয়ার রহমান বলেন, ‘আশি বা নব্বইয়ের দশকে তিস্তা ও ধরলায় শুশুক, ডলফিন, ঘড়িয়াল প্রায়ই দেখা যেত। বোরালি মাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ব্যাপক পরিমাণে পাওয়া যেত। কিন্তু, বর্তমানে তিস্তা ও ধরলায় পানি সংকটের কারণে বাংলাদেশ অংশে এসব মাছ ও প্রাণি চোখে পড়ে না। তবে এই দুই নদীর উৎপত্তিস্থল ভারতে হওয়ায় এখনও এসব প্রাণি ও মাছ দেখা যায়। এসব জলজ প্রাণি ও দেশি মাছের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে অবশ্যই পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।’
জানতে চাইলে লালমনিরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফারুকুল ইসলাম বলেন, ‘আমি সবেমাত্র লালমনিরহাটে নতুন যোগদান করেছি। শুনেছি তিস্তা ও ধরলায় বোরালি নামে একটি উচ্চ স্বাদের সুস্বাদু মাছ পাওয়া যায়। এখনও মাছটির সঙ্গে পরিচিত হতে পারিনি। তিনি আরও জানান, ‘লালমনিরহাট জেলায় প্রাকৃতিক উৎসের দেশি মাছের পাশাপাশি চাষের মাছও চাহিদার তুলনায় সংকট রয়েছে। এই জেলায় প্রতিদিন প্রতিজন মানুষের জন্য ৬০ গ্রাম মাছ প্রয়োজন। সেই হিসেবে বাৎসরিক মাছের চাহিদা ২৮ হাজার ৫৮৪ দশমিক ৯৩ মেট্রিক টন কিন্তু উৎপাদনে ১০ হাজার ১২৪ দশমিক ৯৩ মেট্রিক টনই ঘাটতি রয়েছে।’
লালমনিরহাট সদর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা তারিফুর রহমান সরকার বলেন, ‘লালমনিরহাটে বাৎসরিক রেণু পোনার চাহিদা ৯ হাজার ৫৪৮ কেজি। ৬৪৮টি নার্সারের ৭৩৭টি পুকুরে ৫২শ ৬০ কেজি রেণু পোনা উৎপাদন করা হয়। এখনও ৪২শ ৮৮ কেজি রেণু পোনা উৎপাদন ঘাটতি রয়েছে। যা বাইরে থেকে সংগ্রহ করা হয়। এছাড়া ৫-৬ ইঞ্চি পোনার চাহিদা ১৬শ ৩০ মেট্রিক টন। ৩৫০ জন পোনা চাষী ৬৪৩টি পুকুরে ১৫শ ১৩ দশমিক ১৩ মেট্রিক টন উৎপাদন করতে সক্ষম হলেও ১শ ১৬ দশমিক ৮৭ মেট্রিক টন উৎপাদন ঘাটতি রয়েছে। মৎস্য বিভাগ চেষ্টা করছে এসব ঘাটতি মোকাবিলা করার।