নদীতে ঝাঁপ দিয়ে শিশুসন্তানসহ বেঁচে গেলেন সোনিয়া

এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ভয়ংকর পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়েছেন বরগুনার তালতলী উপজেলার সোনিয়া বেগম (২৫)। তিনি সদরঘাট থেকে বৃহস্পতিবার বিকালে লঞ্চে ওঠেন। ইঞ্জিন রুমের ওপর বরাবর দোতলার ডেকে ছিলেন সোনিয়া। তার সঙ্গে ছিলেন মা রেখা বেগম (৫৪), বড় ছেলে জুনায়েদ শিকদার (৬) এবং কোলে ছিল ১৫ মাসের শিশুসন্তান। লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের পর শিশুসন্তানকে কোলে নিয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণে বাঁচলেও এখন পর্যন্ত নিখোঁজ রয়েছেন তার মা ও বড় ছেলে।

সোনিয়া বেগম বলেন, ‘সন্ধ্যা ৬টার পর লঞ্চটি সদরঘাট থেকে যাত্রা শুরু করে। কিছু দূর যাওয়ার পরই লঞ্চের ডেক গরম হয়ে যায়। সেই সঙ্গে লঞ্চের গতি বেড়ে যায়। তখন ইঞ্জিন রুম থেকে শব্দ শুনছিলাম। বিষয়টি স্টাফদের জানানোর পর ডেকের ওপর কম্বল বিছিয়ে দিয়েছিল তারা। তাতেও ডেকের উত্তাপ কমছিল না। বাইরে থেকে ঠান্ডা বাতাস আসায় অনেকের কাছে ওই উত্তাপ স্বাভাবিক মনে হয়েছিল। এভাবেই চলছিল লঞ্চটি। রাতে অনেকে ঘুমিয়ে পড়েছিল।’

তিনি বলেন, ‘লঞ্চে আগুন লাগার সময় ইঞ্জিন রুমের ওপরে দোতলার ডেকে বসেছিলাম আমরা। আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে ডেক গরম হয়ে চারদিক ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। ওই অবস্থায় লঞ্চটি চলছিল প্রায় একঘণ্টা। আগুনের ভয়াবহতা দেখে অনেকে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। যাত্রীরা ছোটাছুটি করছিল চারদিকে। যে যেভাবে পেরেছে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করেছে। এই ফাঁকে মা ও বড় ছেলেকে হারিয়ে ফেলি আমি। অবস্থা বেগতিক দেখে শিশুকে কোলে নিয়ে লঞ্চের সঙ্গে বাঁধা দড়ি বেয়ে নিচতলায় নামি। এরপর শিশুসন্তানকে কোলে নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিই। পরে সাঁতরে তীরে উঠি। কীভাবে আমরা বেঁচে গেছি, জানি না।’ 

সোনিয়া বেগম বলেন, ‘লঞ্চের ইঞ্জিন রুম থেকে আগুন ধরেছিল। সকাল থেকে আমার মা এবং বড় ছেলেকে খুঁজছি। আমি তাদের খুঁজে পাচ্ছি না।’

একই পরিস্থিতির কথা জানিয়েছেন প্রাণে বেঁচে যাওয়া আহত যাত্রী বরগুনা সদরের রিফাত হোসেন। তিনি বলেন, ‘আগুন ছড়িয়ে পড়লে লঞ্চের স্টাফরা কেবিনের বাইর থেকে দরজা-জানালা বন্ধ করে দেয়। এ জন্য যাত্রীরা আরও সংকটাপন্ন পরিস্থিতির মুখে পড়ে। রাত ২টা থেকে আগুন জ্বলতে থাকে। অনেক যাত্রী নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতরে তীরে উঠতে পেরেছেন। অনেকে পারেননি। লঞ্চে আটকে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু।’

এদিকে, সুগন্ধা নদীতে স্মরণকালের ভয়াবহ লঞ্চ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বরগুনায় শোকাবহ পরিবেশ বিরাজ করছে। লঞ্চের অধিকাংশ যাত্রীর বাড়ি বরগুনা জেলায়। মারা যাওয়া বেশিরভাগই নারী ও শিশু বলে জানা গেছে।

বৃহস্পতিবার রাত ৩টার দিকে নলছিটির সুগন্ধা নদীর পোনাবালীয়া ইউনিয়নের দেউরী এলাকায় এলে লঞ্চের ইঞ্জিন রুমে আগুন ধরে যায়। 

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সকালে উদ্ধার অভিযান শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত লঞ্চের ভেতর এবং নদী থেকে ৪০ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা যান আরও একজন। এরমধ্যে পাঁচ জনের লাশ শনাক্ত করে নিয়ে গেছেন স্বজনরা।

প্রাণে বেঁচে যাওয়া আহত যাত্রী বরগুনা সদরের রিফাত হোসেন

তবে ৩৬ জনের লাশ ঝালকাঠি সদর হাসপাতালের মর্গে ও বাইরে রাখা হয়েছে। সেখানে স্বজনরা ভিড় করছেন। বেশিরভাগ লাশ বিকৃত হয়ে যাওয়ায় চিনতে পারছেন না কেউ।

মৃতদের মধ্যে বরগুনার দুই জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা হলেন বেতাগী উপজেলার কাজিরাবাদ ইউনিয়নের মো. রিয়াজ (২৩) এবং বরগুনার সদরের ফুলঝুরি ইউনিয়নের আট বছরের শিশু তাইফা। শিশু তাইফা মারা গেলেও গুরুতর আহত অবস্থায় বেঁচে আছেন তার বাবা বশির আহমদ। আহতদের খোঁজখবরসহ মৃতদের লাশ গ্রহণের জন্য বরগুনা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি টিম ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়েছে।

এদিকে, লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মৃতদের পরিবারকে দেড় লাখ টাকা এবং লাশ দাফনের জন্য প্রত্যেক পরিবারকে আরও ২৫ হাজার টাকা করে দেওয়ার কথা জানিয়েছেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী।  

লঞ্চ দুর্ঘটনায় বরগুনা-১ আসনের সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু, কেন্দ্রীয় যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য সুভাষ চন্দ্র হাওলাদার, বরগুনা জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান, প্রেস ক্লাবের সভাপতি সঞ্জীব দাস, পৌর মেয়র কামরুল আহসান মহারাজ গভীর শোক ও সমবেদনা জ্ঞাপন করেছেন।