‘আইজ ৭-৮ দিন থাইকা চারদিকে পানি। পোলাডার কাজকাম নাই, কামলা চলে না। একবেলা খাইতে পারলেও আরেক বেলা জোটে না। কোনও সাহায্যও পাই নাই। আমগো খুব কষ্টে দিন কাটতাছে।’ এভাবেই নিজের কষ্টের কথাগুলো বলছিলেন কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার যাদুরচর ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের চর লালকুড়ার পানিবন্দি বৃদ্ধা আছিয়া খাতুন। গত তিনমাস আগে ঝড়ে আছিয়া খাতুনের বসতবাড়ির ঘর উড়ে যায়। সেই থেকে সরকার থেকে পাওয়া তাবুতে বসবাস করছেন আছিয়া খাতুন। কিন্তু এখন বন্যা পরিস্থিতিতে বিড়ম্বনা বেড়েছে এই বৃদ্ধার।
পানিবন্দি দশায় ছেলে নুর হোসেন কর্মহীন হয়ে পড়ায় আছিয়া খাতুনের ঘরে খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। শুধু আছিয়া খাতুন নন, সপ্তাহকাল ধরে পানিবন্দি থাকা জেলা সদর থেকে নদী দ্বারা বিচ্ছিন্ন রৌমারীর অনেক পরিবারে এখন খাদ্য সংকট।
শুধু পানিবন্দি মানুষ নয়, খাদ্য সংকটে পড়েছে ওই এলাকার গবাদিপশু। দুর্গত এলাকার অনেকের কাছেই পৌঁছেনি সরকারি কিংবা বেসরকারি ত্রাণ সহায়তা। এমন অভিযোগ ওই এলাকার ভুক্তভোগীদের।
যাদুরচর ইউনিয়নের ধনারচর নতুনগ্রাম, যাদুরচর নতুনগ্রাম, ধনারচর আকন্দ পাড়া, ধনারচর চরেরগ্রাম, যাদুরচর চাক্তাবাড়ি, ধনারচর টাংড়াপাড়া, কোমরভাঙ্গি পাখিউড়া; রৌমারী সদর ইউনিয়নের চাক্তাবাড়ি, কান্দাপাড়া; চরশৌলমারী ইউনিয়নের ঘুঘুমারী, সুখেরবাতি, চরগেন্দার আলগা, খেদাইমারী, পশ্চিম খেদাইমারী, সোনাপুর, চরঘুঘুমারীসহ উপজেলার ৬০ গ্রামের অর্ধলক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন।
বানের পানিতে ভেসে গেছে এসব এলাকার মাছের ঘের। তলিয়ে গেছে কৃষকের ধান, পাটসহ নানা ফসলি জমি। বানের পানিতে তলিয়েছে চারণ ভূমি, ভেসে গেছে জমিতে থাকা খড়। এছাড়া রৌমারীর নতুনবন্দর স্থলবন্দর ও বালিয়ামারী সীমান্ত (বাংলাদেশ-ভারত) হাঁটু পানিতে প্লাবিত হয়েছে।
যাদুরচর ইউনিয়নের ধনারচর আকন্দপাড়ার কৃষক জুয়েল মিয়া বলেন, পরিবারের লোকজনের পাশাপাশি বাড়িতে থাকা গবাদি পশুরও খাদ্য সংকটে পড়েছি। বন্যার পানিতে জমিতে স্তূপ করে রাখা খড় ভেসে গেছে। আশপাশের জমি পানিতে ডুবে যাওয়ায় গবাদিপশুর জন্য ঘাস সংগ্রহ করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে এমন দুর্গতি চললেও কোনও সহায়তা পাননি বলে অভিযোগ করেন এই কৃষক।
জুয়েল মিয়া বলেন, ‘খড় শুকায় জমিতে রাখছি। ঢলে সব ভাইসা গেছে। ঘাসও নাই। অবলা পশু (গরু) গুলারে নিয়া বিপাকে পড়ছি।’ এলাকায় পানিবন্দি থাকা প্রায় ঘরে একই অবস্থা বলে জানান এই কৃষক।
যাদুরচর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সরবেশ আলী বলেন, পাহাড়ি ঢলের পাশাপাশি ব্রহ্মপুত্রের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় আমার ইউনিয়নের নতুন করে আরও সাতটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে ইউনিয়নের প্রায় ২৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। দুর্গতদের জন্য ছয়শ’ প্যাকেট শুকনো খবার বরাদ্দ পাওয়া গেলেও তা অপ্রতুল হওয়ায় অধিকাংশ দুর্গত মানুষের মধ্যে কোনও ত্রাণ পৌঁছাতে পারিনি।
বন্যার পানিতে ফসলের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কাইয়ুম চৌধুরী বলেন, বন্যার পানিতে এ পর্যন্ত (শুক্রবার) উপজেলার দুই হাজার ২৯০ হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে। জলাবদ্ধতায় বেশিরভাগ ফসল নষ্ট হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন এই কৃষি কর্মকর্তা।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে এ কর্মকর্তা বলেন, ‘গো খাদ্য বাবদ এখন পর্যন্ত কোনও বরাদ্দ পাওয়া যায়নি।’
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) আজিজুর রহমান জানান, উপজেলার ৬০টি গ্রামের অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। দুর্গতদের জন্য তিন লাখ টাকার শুকনো খাবার কেনা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার যাদুরচর ইউনিয়নে ছয়শ’ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। নতুন করে জিআরের ১০ মেট্রিক টন চালসহ এক লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে।
গবাদি পশুর খাদ্য সরবরাহের বিষয়ে পিআইও বলেন, ‘গো খাদ্যের জন্য আমাদের দেড় লাখ টাকা বরাদ্দ রয়েছে। তবে আমরা এখনও গোখাদ্য কিনতে পারিনি।’
উপজেলায় দুর্গতদের সহায়তার বিষয়ে জানতে ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আশরাফুল আলম রাসেলের ফোনে একাধিকবার কল করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি।