বৃষ্টির আশায় ‘নগর বিয়ে’

হিন্দুপুরাণের তথ্যমতে স্বর্গের দেবরাজ ইন্দ্র ও তার রানি শচীদেবীর বিয়ে হলো মর্ত্যে। বৃষ্টির এই দেবতাকে খুশি করতে ধুমধামে ‘নগর বিয়েতে’ ছিল সব ধরনের আয়োজন। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, এমন আয়োজন করলে দেবরাজ ইন্দ্র খুশি হয়ে বৃষ্টি দেবেন মর্ত্যলোকে। ফলে চলমান দাবদাহ নিরসন হবে। শান্তি নামবে পৃথিবীতে।

এ জন্য দিনাজপুরে ঢাকঢোল ও বাদ্যযন্ত্রের শব্দে নেচে গেয়ে ধুমধামে বিয়ে দেওয়া হলো স্বর্গের দেবতাদের রাজা ইন্দ্র ও তার রানি শচীদেবীর। সদরের দক্ষিণ নগর, কামারপাড়া ও গোপালপুর এলাকায় সোমবার দিবাগত রাতভর পর্যায়ক্রমে চলে বিয়ের আয়োজন। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, এমন বিয়ের ফলে ভগবান ইন্দ্র খুশি হয়ে ধরায় বৃষ্টি দেবেন।

গত প্রায় ২০ দিন ধরে চলছে তীব্র দাবদাহ ও প্রচণ্ড খরা। পুড়ছে উত্তরের জেলা দিনাজপুর। বৃষ্টির আশায় হাহাকার করছে মানুষ, উদ্ভিদ ও প্রাণীকূল। এ যখন অবস্থা তখন প্রকৃতির সৃষ্টিকর্তার প্রতি সব ধর্মের প্রার্থনা একটুখানি বৃষ্টির জন্য। বৃষ্টির জন্য গত কয়েকদিন ধরেই চলছে নিজ নিজ ধর্মের সৃষ্টিকর্তার প্রতি প্রার্থনা। হয়েছে ব্যাঙের বিয়ে ও ও ইস্তিখারার নামাজ। এবার হলো নগর বিয়ে।

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, এমন বিয়ের আয়োজন করলে দেবরাজ ইন্দ্র খুশি হয়ে বৃষ্টি দেবেন মর্তলোকে

সোমবার রাত ১০টায় সদর উপজেলার শেখপুরা ইউনিয়নের দক্ষিণনগর, রাত ১২টায় একই ইউনিনের নুলাইবাড়ি কর্মকারপাড়ায় এবং মঙ্গলবার ভোররাতে উত্তর গোপালপুর গ্রামে এ বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়।

রাতে কর্মকারপাড়ায় গিয়ে দেখা গেছে, নুলাইবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা ও দিঘন এসসি উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষক রতন কুমার কর্মকারের বাড়ির উঠানে চলছে বিয়ের আয়োজন। মূলত এ বিয়ের উদ্যোক্তা তিনি। বিয়েতে কমপক্ষে পাঁচ শতাধিক লোকজন এসেছেন বিভিন্ন গ্রাম ও মহল্লা থেকে। বিয়েতে বর ইন্দ্র দেব হিসেবে আসনে বসেন ওই এলাকার বাসিন্দা প্রাণকৃষ্ণ ও কনে কলাবতী হিসেবে আসনে বসেন প্রদীপ রায়। বিয়েতে বরের বাবা ছিলেন ললিত মোহন রায়। কন্যাদান করেন রতন কুমার কর্মকার।

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থের তথ্যমতে, দ্বাদশ আদিত্যের মধ্যে একজন ইন্দ্র, যাকে বজ্রপাত ও বৃষ্টির দেবতা হিসেবে মানা হয়। একসময় মর্তলোকে প্রচণ্ড খরা হয়েছিল। ওই সময়ে মানুষের দুঃখ দেখে দেবরাজ ইন্দ্রের কাছে তার স্ত্রী শচীদেবী গিয়ে বলেছিলেন, মর্তলোকে বৃষ্টি দিতে। আর মর্তলোকের মানুষের দুঃখ ঘোচানোর জন্য শচীদেবী দেবরাজ ইন্দ্রকে তুষ্ট করতে মর্তবাসীকেও দেবরাজের পূজা করতে বলেছিলেন। ওই সময়ে দেবরাজকে তুষ্ট করতে মর্তবাসী এমন বিয়ের আয়োজন করেন। সেই থেকেই নগর বিয়ের আয়োজন চলে আসছে।

ওই এলাকার বাসিন্দা পলাশ রায় বলেন, ‘আমি এর আগে এমন বিয়ে দেখিনি। আজ বিয়ের আয়োজন করেছেন রতন স্যার। তিনি অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক এবং জ্ঞানী মানুষ। ধর্মীয় বিশ্বাস থেকেই এমন আয়োজন। প্রকৃতির ওপর কারও হাত নেই। সৃষ্টিকর্তাকে খুশি করতে পারলেই আমাদের মনের আশা পূরণ হবে।’

গোপালপুর এলাকায় সোমবার দিবাগত রাতভর পর্যায়ক্রমে চলে বিয়ের আয়োজন

দক্ষিণনগর এলাকার বেনু রাম সরকার বলেন, ‘আমাদের এলাকায় নগর বিয়ে হয়েছে। সোমবার সন্ধ্যা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত বিয়ের অনুষ্ঠান চলেছে। আমরা বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করেছি। কারণ বৃষ্টির অভাবে ক্ষেত-খালবিল ও ফসল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমন ধানের চারা রোপণ করতে পারছি না। তাই ইন্দ্রদেবের কাছে নগর বিয়ের মাধ্যমে বৃষ্টির প্রার্থনা করেছি।’

রতন কুমার কর্মকার বলেন, ‘আমাদের এ আয়োজন বৃষ্টির দেবতা ইন্দ্রকে তুষ্ট করার জন্য। এখন যে অবস্থা, সাধারণত এই সময়ে দাবদাহ হওয়ার কথা নয়। ভরা বর্ষায় এমন খরা আমাদের চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। আমরা জানি, নগর বিয়ের আয়োজন করলে ভগবান তুষ্ট হয়ে ধরায় বৃষ্টি দেন। তাই এমন আয়োজন।’

নগর বিয়ের পুরোহিত পরিতোষ চক্রবর্তী বলেন, ‘এমন রীতি যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। ইন্দ্ররাজ ও শচীদেবীর বিয়ে দেওয়া হয় অনাবৃষ্টি দেখা দিলে। পূর্বপুরুষদের সেই রীতি ধরে রাখতে এবং নিয়ম মেনেই বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে। এটি প্রতীকী বিয়ে। বিয়ের মাধ্যমে প্রার্থনা, অনাবৃষ্টির হাত থেকে ভগবান আমাদের রক্ষা করুন।’