জমিতে ঝরছে কৃষকের ১২০০ মণ ধান

দেশে খাদ্য সংকটের আভাস দিচ্ছেন খোদ সরকারের উপরের মহলের কর্তারা। জমি অনাবাদী না রাখতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশনা দিয়েছেন। ঠিক এই সময়ে দিনাজপুরের বীরগঞ্জে ক্ষেতেই নষ্ট হচ্ছে বর্গাচাষিদের ২২ একর জমির প্রায় ১২০০ মণ (৪৮ টন) ধান। ধারদেনা করে জমিতে ফসল ফলালেও ঘরে তুলতে পারছেন না চাষিরা। হঠাৎ মালিকানা দ্বন্দ্বের জেরে খড়গ পড়েছে বর্গাচাষি কৃষকদের ঘাড়ে, ফলে বাড়ছে উৎকণ্ঠা। সরকারি পদক্ষেপে হলেও ধান রক্ষার দাবি জানিয়েছেন কৃষক ও সংশ্লিষ্টরা। যদিও পুলিশ বলছে, এসব জমির ধান কাটতে আইনি কোনও বাধা নেই।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার মরিচা ইউনিয়নের বাদলাপাড়া গ্রামের জমির বেশিরভাগ ধানই কাটা হয়েছে। তবে ওই গ্রামের বাদলাপাড়া ও ছিড়াবাজু মৌজার প্রায় ২২ একর জমির ধান এখনও কাটা হয়নি। ধান পেকে গেছে, কাটার উপযুক্ত সময় অতিক্রম হলেও এসব ধান না কাটায় জমিতে ঝরে নষ্ট হচ্ছে।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন ধরে ওই এলাকার প্রায় ৩৫ একর জমির মধ্যে ২২-২৪ একর জমি চাষাবাদ করে আসছেন কিছু বর্গাচাষি। এসব জমি বর্গা নিয়েছেন একই এলাকার রিয়াজুল ইসলামের কাছ থেকে। এতদিন কোনও সমস্যা না হলেও এবার ধান কাটার সময় বাধা দেন একই এলাকার ওয়াসিম, মাহবুব হোসেন, শাহনাজ পারভীনসহ অনেকে। মালিকানা দ্বন্দ্বের জেরে ক্ষেতেই নষ্ট হচ্ছে ২২ একর জমির প্রায় ১২০০ মণ ধান। এসব ধান ঘরে তুলতে না পারায় বর্গাচাষিদের মধ্যে দেখা দিয়েছে হাহাকার ও উৎকণ্ঠা।

দীর্ঘদিন ধরেই বর্গাচাষের মাধ্যমে ১০ কাঠা জমিতে ধান আবাদ করছেন বাদলাপাড়া গ্রামের অফিজ উদ্দিন। তবে এবারে পড়েছেন বিপাকে, জমিতে ধান পেকে গেলেও বাধার মুখে ঘরে তুলতে পারছেন না। বর্গার জমির মালিকানা দ্বন্দ্বের জেরে ক্ষেতেই নষ্ট হচ্ছে। কথা হলে তিনি বলেন, ‘আমরা বর্গাচাষি। চুক্তি নিয়ে ধান আবাদ করেছি। ধারদেনা করে এই জমি আবাদ করেছি। এখন ধান কাটতে পারছি না। জমি নিয়ে কী সমস্যা রয়েছে সেটা তো আমরা জানি না। আমরা ধানগুলো কেটে ঘরে তুলি, তারপর তারা কী করবেন আমরা জানি না। সরকার বলছে, কোন জমি না ফেলে রাখতে। আর সেখানে আমাদের আবাদ করা ধানই জমিতে নষ্ট হচ্ছে। এটা কি সরকারের ক্ষতি হচ্ছে না, আমাদের ক্ষতি হচ্ছে না।’

dinajpur3

বর্গাচাষি আব্দুর রশিদ বলেন, ‘আশপাশের সবাই ধান কেটে নিয়ে গেছে। কিন্তু আমার ধান কাটতে পারছি না। আমাদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এখানে আমাদের কী দোষ? আমাকে বলে, জমি কী তোর বাপের? জমি আমি আবাদ করেছি। বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে খাইতে হবে। ঢাকায় রিকশা চালাই। সেখানে উপার্জন করে ছেলেটাকে পড়ালেখা করাই, মানুষ করতে চাই। এই ধান সারা বছর খাবো। এখন তো ছেলেটাকে মানুষ করার কোনও উপায় দেখছি না।’

ইমরা বেগম বলেন, ‘এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ধান গারছি, মেশিন দিয়া পানি দিয়া ধান লাগাইছি। এখন তো কাটিবার দেয় না। কাটতে গেলেই বাধা দিচ্ছে। ক্ষেতের মধ্যে ধান নষ্ট হচ্ছে, এখন আমরা কী করবো।’

রোজিনা বলেন, ‘আমার স্বামী নাই, বোনেরও স্বামী নাই। দুই বোন মিলে ১০ কাঠা জমি এক লাখ টাকা দিয়া বন্ধক নিছি। আমরা ধান কাটি নিয়া যাই, তারপর আর ক্ষেতে আসবো না বলেছি। কিন্তু তারা আমাদেরকে ধান কাটতে দিচ্ছে না। আমরা কষ্ট করে ধান করছি, ধান কাটি নিয়া যাবে, এটা চাচ্ছি। আমরা মাটি নিছি, মেলা দিন থাকি আবাদ করছি। এখন বলছে, এটাত ভেজাল আছে। আমরা তো ভেজাল আছে কি না জানি না। ধান কাটি নিয়া তারপর যাকে টাকা দিছি তার কাছ থেকে টাকা ঘুরে নিবো।’

dinajpur5

রোজিনার বোন মজিরন বলেন, ‘আমি মাঠে কাজ করছি, আমার বোন ঢাকায় কাজ করেছে। ওই টাকা দিয়া আমরা জমি ফেরত (বন্ধক) নিছি। ওই জমির টাকা দিয়া মেয়ের যৌতুকের টাকা দিবো।’

কৃষকরা এসব জমি বর্গা ও বন্ধক নিয়েছেন ওই এলাকার রিয়াজুল ইসলামের কাছ থেকে। তার সঙ্গে কথা হলে বলেন, ‘এসব জমি আমি পৈতৃক সূত্রে মালিক। পাশাপাশি বেশ কিছু জমি কিনেছি। দীর্ঘদিন ধরেই আমি এসব জমি ভোগদখল করে আছি। এখন হঠাৎ তারা এই জমি দাবি করছেন। আমাদের হয়রানি করছেন। এখন আমার বর্গচাষিদের ধান কাটতে বাধা দিচ্ছেন। ফলে আমি ও আমার বর্গচাষিরা জমিতে যেতে সাহস পাচ্ছি না। থানায় গিয়েছি এবং আইনের আশ্রয় নিয়েছি।’

dinajpur1

তার ছেলে শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘আমার বর্গাচাষিরা জমিতে ধান লাগিয়েছে। এখন প্রতিপক্ষরা বিভিন্ন লোকজন নিয়ে বর্গাচাষিদের বাধা দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার বলছেন, যেন জমি ফেলে না রাখা হয়, সব জমি আবাদ করা হয়। কিন্তু এখানে আবাদ করা ধান ঘরে তুলতে পারছেন না কৃষকরা। এ জন্য প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। বর্গচাষিরা যখন ধান রোপণ করেছেন তখন কোনও বাধা দেয়নি, কিন্তু এখন যখন ধান পেকে গেছে, ধান কাটতে দিচ্ছে না। এর আগে তাদের সঙ্গে বসা হলেও তারা স্বপক্ষে কোনও কাগজপত্র দেখাতে পারেনি।’

তবে এ বিষয়ে কথা বলতে চাননি ধান কাটতে বাধা দেওয়া মাহবুব হোসেন, শাহানাজ পারভীনসহ অন্যরা। তবে ওয়াসিম বলেন, ‘এটা নিয়ে আমি কোনও সাক্ষাৎকার দেবো না। ওসি বলেছেন, ‘‘সমন্বয় না হওয়া পর্যন্ত দুই পক্ষ ধান কাটবেন না। আমরা কোনও ধান কাটতে যাইনি’’।’

বীরগঞ্জ থানার ওসি সুব্রত সরকার বলেন, ‘ধান কাটতে আমাদের তরফ থেকে কোনও বাধা নেই। আমরা কাউকে ধান কাটতে নিষেধ করিনি।’