আজকের দিনে হানাদার মুক্ত হয় হিলি

আজ ১১ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের এই দিনে হানাদারমুক্ত হয় দিনাজপুরের সীমান্তবর্তী এলাকা হিলি। এদিন হিলির মুহাড়াপাড়ায় দেশের সর্ববৃহৎ সম্মুখযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল বলে দাবি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। যুদ্ধ চলাকালীন এখানে প্রায় সাত হাজার পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। শহীদ হন প্রায় ১৩০০ মুক্তিযোদ্ধা এবং মিত্র বাহিনীর ৩৪৫ জন সদস্য। আহত হন অনেকে। যুদ্ধের পর ১১ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের ৭ নম্বর সেক্টরের আওতায় হিলি শত্রুমুক্ত হয়।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বিভিন্ন স্থানে সম্মুখ ও গেরিলা যুদ্ধে হাকিমপুর উপজেলার বোয়ালদাড় গ্রামের মোস্তফা, একরাম উদ্দিন, বানিয়াল গ্রামের মুজিব উদ্দিন, ইসমাইলপুর গ্রামের মনিরুদ্দিন, মমতাজ উদ্দিন, বৈগ্রামের ইয়াদ আলী ও চেংগ্রামের ওয়াসিম উদ্দিন শহীদ হন।

বীর মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল আবেদীন ও আলতাফ হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, ১৯৭১ সালে দেশে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছিল। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যেকোনও মুহূর্তে পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে সংঘর্ষ শুরু হকে পারে। এ অবস্থায় সারাদেশের সঙ্গে হাকিমপুর তথা হিলি এলাকার নেতাদের আহ্বানে সমাজ সেবক খলিলুর রহমান ও ডা. আবুল কাশেমকে স্বেচ্ছাসেবক কমিটি গঠনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। স্কুল কলেজের উৎসাহী যুবক, আনসার ও মুজাহিদদের সমন্বয়ে বাংলাহিলি বালিকা বিদ্যালয়ে একটি সেচ্ছাসেবক কমিটি গঠন করা হয়। 

ঢাকায় ২৫ মার্চ রাতে হানাদার বাহিনীর বর্বর হামলার পর তারা যাতে হাকিমপুরে প্রবেশ করতে না পারে সেই লক্ষ্যে হিলির সেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্যরা আগে থেকেই সড়কে গাছ কেটে ও রাস্তা খুঁড়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রাখে এবং বিভিন্ন প্রতিরক্ষামুলক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে। এক পর্যায়ে থানা ও ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) ক্যাম্প থেকে সেচ্ছাসেবক বাহিনীর কাছে ৩০৩টি রাইফেল হস্তান্তর করা হয়। এ সময় তৃতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর নিজাম উদ্দিন ১৭টি গাড়ি বহরসহ বেশ কিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ফুলবাড়িতে এসে অবস্থান নেয়। ওই সেচ্ছাসেবক দলকে হিলি ইপিআর ক্যাম্পের সুবেদার শুকুর আলীর নেতৃত্বে কয়েকজন ইপিআরকে বিহারী অধ্যুষিত পার্বতীপুরের হাবড়ায় খান সেনাদের প্রতিরোধ করার জন্য পাঠানো হয়। এ সময় সেখানে সেচ্ছাসেবক দলের সাথে হানাদারদের সম্মুখ যুদ্ধ শুরু হয়। প্রচন্ড শেলিং ও বিভিন্ন ধরনের গোলার আঘাতে সেচ্ছাসেবক দলের ৯ জন যোদ্ধা সে সময় শহীদ হন। কয়েক দিন পর ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেন সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে দলবলসহ গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হিলিতে এসে অবস্থান নেয় এবং অত্র এলাকার প্রতিরক্ষার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। 

তারা আরও জানান, এক পর্যায়ে হানাদার বাহিনী আক্রমণ শুরু করলে ১৯, ২০ ও ২১ এপ্রিল হিলিতে কয়েক দফা তুমুল যুদ্ধ হয়। হানাদারদের মোকাবিলা করতে গিয়ে ক্যাপ্টেন আনোয়ারের দলের দুই জন শহীদ হন। তখন ক্যাপ্টেন আনোয়ার দল রিয়ে ভারতের বালুরঘাটের তিওড়ে অবস্থান নেন। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের বালুরঘাট ট্রানজিট ক্যাম্পে তালিকাভুক্ত করে পতিরামে ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠানো হয়। ক্যাপ্টেন আনোয়ার ও তার দলের কয়েকজন সদস্য মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক ট্রেনিং প্রদান করেন। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সেচ্ছাসেবক দল মুক্তিযোদ্ধাদের সুসংগঠিত করা হয়। ট্রেনিং প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্নভাবে গেরিলা ও সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন।

হানাদাররা হিলি থেকে তিন মাইল পূর্বে ছাতনী গ্রামে শক্ত ঘাটি প্রতিষ্ঠা করে। বিভিন্ন দিকে ক্যাম্প গঠনের মাধ্যমে ভারী অস্ত্র-সস্ত্রে সজ্জিত হয়ে অবস্থান গ্রহণ করে এবং মুহাড়া পাড়ায় তারা একটি গভির খাল কেটে বেশ কয়েকটি বাংকার তৈরি করে। ৬-৭ হাজার পাকিস্তানি সেনা ৪০টি ট্যাংক নিয়ে সেখানে অবস্থান করতে থাকে। ভারত ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারকে সমর্থন দানের পর হিলিতে ভারত-বাংলাদেশ মিত্র বাহিনীর সঙ্গৈ পাকিস্তানি সেনাদের যুদ্ধ শুরু হয়। প্রথম দিকে হিলির মুহাড়াপাড়া এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাসহ মিত্র বাহিনী ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এ সময় তরুণ মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা শহীদ হন। পরে মিত্রবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধারা সুসংগঠিত হয়ে ১০ ডিসেম্বর মুহাড়াপাড়া এলাকাসহ হানাদারদের বিভিন্ন আস্তানায় আকাশ ও স্থলপথে একসঙ্গে হামলা চালায়। দুই দিন ধরে তুমুল যুদ্ধের পর হানাদার বাহিনী পরাস্ত হয়। ১১ ডিসেম্বর দুপুর ১টার দিকে মুক্তিযুদ্ধের ৭ নম্বর সেক্টরের আওতায় দিনাজপুরের হিলি শত্রুমুক্ত হয়।

বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ হাকিমপুর উপজেলা কমান্ডের সাবেক কমান্ডার লিয়াকত আলী বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, হিলির মুহাড়াপাড়া এলাকায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন স্বরূপ সেখানে স্মৃতিস্তম্ভ ‘সম্মুখ সমর’ দীর্ঘ ৪২ বছর পর নির্মাণ করা হয়েছে। যেখানে আমরা এই দিনে ফুল দিয়ে শুদ্ধা নিবেদনসহ দোয়ার মাধ্যমে তাদের স্মরণ করে থাকি। কিন্তু সেদিনের যুদ্ধে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর শহীদ সদস্যদের স্মৃতি রক্ষার্থে হিলি সীমান্তের ভারত-বাংলাদেশ শূন্যরেখার পার্শ্বে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মানেরও দাবি জানাচ্ছি, যাতে এটি দেখলে সেদিনের সেই কথা মনে পড়ে।

এদিকে র‌্যালিও আলোচনা সভার মধ্য দিয়ে হিলি শত্রুমুক্ত দিবস উদযাপন করা হয়েছে। দিবসটি উপলক্ষে হাকিমপুর উপজেলা প্রশাসনের আয়োজনে দুপুর ১২টায় উপজেলা পরিষদের সভাকক্ষে এক আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে বক্তারা সেদিনের সেই স্মৃতি তুলে ধরেন ও কীভাবে হানাদার বাহিনীর কাছ থেকে হিলি শত্রুমুক্ত হয়েছিল স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধারা সেসব নিয়ে আলোচনা করেন। সভা শেষে উপজেলা পরিষদ চত্বর হতে একটি র‌্যালি বের হয়ে হিলি স্থলবন্দরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে আবারও একই স্থানে গিয়ে শেষ হয়।

এতে উপজেলা চেয়ারম্যান হারুন উর রশীদ, ভাইস চেয়ারম্যান শাহিনুর রেজা শাহিন, সহকারি কমিশনার (ভুমি) মোকলেদা খাতুন, কৃষি কর্মকর্তা মমতাজ সুলতানা, অতিরিক্ত কৃষি অফিসার আরজেনা বেগম, সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার লিয়াকত আলী, বীর মুক্তিযোদ্ধা সামছুল আলম, হিলি স্থলবন্দরের জনসংযোগ কর্মকর্তা সোহরাব হোসেন, মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ডের সাবেক সভাপতি জাহিদুল ইসলাম, প্রেসক্লাবের সভাপতি গোলাম মোস্তাফিজার রহমানসহ বীর মুক্তিযোদ্ধা, রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।