এক পরিবারের ১৩ জন শহীদ, আজও মেলেনি স্বীকৃতি

‘আমার বাবা-মাসহ ১৩ জন ভারতের উদ্দেশে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাই। ওই দিন বিকালে কালীগঞ্জ বাজারে যেতেই হঠাৎ পাকিস্তানি সেনার তিন-চারটি গাড়ি এসে থামে। আমাদের সবাইকে দাঁড় করায়। তারপর গুলি করে হত্যা করে। এ সময় আমার ডান হাতে একটি গুলি লাগে। আরেকটি পিঠের ওপর দিয়ে চলে যায়। ভগবানের কৃপায় আমি সেদিন বেঁচে যাই।’

নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার বালাগ্রাম ইউনিয়নের পশ্চিম বালাগ্রামের বাসিন্দা অমর কৃষ্ণ অধিকারী এভাবেই কথাগুলো বললেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তার পরিবারের ১৩ জন সেদিন শহীদ হয়েছেন। কিন্তু এমন বিরল ঘটনার আজও মেলেনি কোনও স্বীকৃতি।

জানা যায়, ১৯৭১ সালের ২৭ এপ্রিল সকাল ১১টার দিকে উপজেলার গোলনা ইউনিয়নের কালীগঞ্জ গ্রামে ঘটনাটি ঘটেছিল। রাজাকারসহ পাকিস্তানি সেনারা সেদিন তিন শতাধিক নিরাপরাধ মানুষকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে।

ওই ঘটনায় বেঁচে যাওয়া অমর কৃষ্ণ অধিকারীর বয়স আজ ৬৯। সেদিন তিনি ছিলেন দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী।

কালের সাক্ষী অমর কৃষ্ণ ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, সেদিন পাকিস্তানি সেনারা শিশু ও বৃদ্ধদের মারেনি। এ কারণে আমার ছোট ভাই-বোনরা প্রাণে বেঁচে যায়। তবে শত শত মানুষকে সেদিন তারা হত্যা করেছে। সেদিন বাবার সঙ্গে ছিলাম তিন ভাই (চারু কৃষ্ণ, বট কৃষ্ণ, রাম কৃষ্ণ অধিকারী) ও চার বোন (মঞ্জু রানী, কুঞ্জ রানী, মায়া রানী ও মিনা রানী অধিকারী)।

তিনি বলেন, এ হত্যাকাণ্ডের পর শান্তি কমিটির সদস্যদের ঘটনাস্থলে পাঠিয়ে মরদেহ মাটিচাপা দেওয়ার নির্দেশ দেয় পাকিস্তানি সেনারা। এ সময় আমি (অমর) পানি খাওয়ার ইশারা করি। তখন তারা আমাকে পানি না দিয়ে বাঁশঝাড়ে ফেলে দিয়ে বাকিদের মাটিচাপা দিয়ে চলে যায়।

পরের দিন (২৮ এপ্রিল) সেখানে গ্রামের মানুষ কবর দেখতে এসে আমাকে উদ্ধার করে। তখন বাড়িতে লোকজন না থাকায় পাশের গ্রামের এক ভগ্নিপতি ঘনেশ্যাম রায় পল্লিচিকিৎসক জামিয়ার রহমানের কাছে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ভারতের কুচবিহারে পৌঁছে দেয়।

পরে বিজিবির (তৎকালীন ইপিআর) সহাতায় কুচবিহার হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে উঠি। এরপর সেখানে আমার পরিবারের লোকজনদের সঙ্গে দেখা হয়। পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে মরে গিয়েও মরি নাই।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, এক পরিবারের ১৩ জন শহীদ হয়। এর মধ্যে আমি বেঁচে আছি। দেশ স্বাধীনের ৫১ বছরেও পাইনি শহীদ পরিবারের স্বীকৃতি। সরকারের কাছে অনুরোধ, শহীদ পরিবারের স্বীকৃতি পেলে শ্বশানে গিয়েও শান্তি পাবো।

অমর কৃষ্ণের ছোট ভাই রামকৃষ্ণ অধিকারী (৫১) জানান, দেশ স্বাধীনের ৫১ বছর গেলেও আমাদের খোঁজখবর কেউ রাখেনি। একটি পরিবারের ১৩ জন মানুষ রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনার হাতে নিহত হওয়ার ঘটনা বাংলাদেশে বিরল। বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রণালয় পর্যন্ত গিয়েছিলাম, তারপর তদন্ত টিম ঢাকা থেকে এসেছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনও সুখবর পাইনি।

ডিসেম্বর ও মার্চ মাস এলে মিডিয়ার লোকজন দল বেঁধে বাড়িতে এসে ছবিসহ নানা তথ্য নিয়ে যান, কিন্তু কোনও কাজই হয় না। পরিবারের পক্ষে দেশবাসীর কাছে আমার শুধু একটাই অনুরোধ, শহীদ পরিবারের স্বীকৃতি পেলেও শ্বশানে আমার বাবার আত্মা শান্তি পাবে।

উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হামিদুল ইসলাম বলেন, ‘উপজেলা পরিষদের আর্থিক সহায়তায় কালীগঞ্জ বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। সেখানে ৭৮ জন শহীদের নামের তালিকা রয়েছে। ওই তালিকায় অশ্বিনী কুমার অধিকারীর নাম আছে।

জলঢাকা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মইনুয়ল ইসলাম বলেন, ‘পরিবারটি সম্পর্কে আমার খুব একটা জানা নেই। আপনার কাছ থেকে প্রথম জানলাম। তবে তাদের সহযোগিতার কোনও সুযোগ থাকলে উপজেলা পরিষদ থেকে তা করা হবে।’