তিনটি এসির সার্ভিসিং খরচ ৪ লাখ ৬৪ হাজার টাকা

রংপুর বিভাগের তিন জেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কমিউনিটি ক্লিনিক, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র মেরামত এবং সংস্কারের নামে অর্থ লোপাট করছে স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর রংপুরের নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়। জেলার স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।

চলতি বছর বিভাগের বিভিন্ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সংস্কারকাজের অর্থ বরাদ্দের কাগজপত্রের জন্য তথ্য অধিকার আইনে অধিদফতরে আবেদন করা হয়। আবেদনের দেড় মাস পর গত ২৫ অক্টোবর স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর রংপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সাহাবুল আলম স্বাক্ষরিত অর্থ বরাদ্দের কাগজপত্রের একটি তালিকা দেওয়া হয়। তালিকার তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত নির্বাহী প্রকৌশলীর অধীনে রংপুর, গাইবান্ধা ও নীলফামারী জেলার বিভাগীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তার কার্যালয়, উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও কমিউনিটি ক্লিনিক ভবন মেরামত ও সংস্কারের জন্য ১৮টি গ্রুপে দরপত্র আহ্বান করা হয়। যার বরাদ্দ ছিল আড়াই কোটি টাকার বেশি। পাশাপাশি রংপুর অঞ্চলের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা ও বিভাগীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তার কার্যালয়ের ভবন সংস্কারের জন্য পৃথক ১৮টি গ্রুপে টেন্ডার আহ্বান করা হয়। এখানে দুই কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে ভবন মেরামতের দরপত্র আহ্বান করা হয়।

এর মধ্যে তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চারটি ভবন মেরামতের জন্য ৩৭ লাখ ৯৯ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। ৩৭ লাখ ৯৮ হাজার টাকা ব্যয় দেখানো হয়। গত ২২ মে সব কাজ সম্পন্ন দেখানো হয়েছে। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দুই জন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ভবন মেরামত ও সংস্কারকাজের জন্য কত টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, কী কী কাজ করা হবে; তা তাদের জানানো হয়নি। এর মধ্যে দুটি ভবন রঙ করেছেন ঠিকাদার। কিছু পুরোনো ফার্নিচার মেরামত করেছেন। তবে যেসব কাজ করা হয়েছে, তার ব্যয় কখনও ৩৭ লাখ ৯৮ হাজার টাকা হবে না। সর্বোচ্চ ১০-১২ লাখ হতে পারে।

একইভাবে নগরীর তাজহাটে অবস্থিত ইনস্টিটিউট অব হেলথ অ্যান্ড টেকনোলোজির ছাত্র হোস্টেলের ভবন মেরামত ও সংস্কারকাজের জন্য চার লাখ ৩৬ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। এই ইনস্টিটিউটের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ভবনের কিছু বিদ্যুতের তার, কয়েকটি ফ্যান ও কিছু চেয়ার-টেবিল মেরামত করা হয়েছে। এসব কাজের বিল চার লাখ ৩৫ হাজার টাকা কোনোভাবেই হবে না। স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর রংপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী ও ঠিকাদার যোগসাজশ করে এত টাকা বিল দেখিয়েছেন। একই রকম অবস্থা ওই প্রতিষ্ঠানের ছাত্রী হোস্টেল ভবনের। এর জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল চার লাখ ৩১ হাজার টাকা। সেখানেও তেমন কোনও কাজ না করে বেশি বিল দেখানো হয়েছে বলে জানালেন এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।

ওই প্রতিষ্ঠানের একাডেমিক ভবন মেরামত ও সংস্কারের জন্য ১৯ লাখ ৯৪ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তিনটি এসি মেরামত, চারটি দরজা-জানালা সংস্কার এবং ভবন রঙ করা ছাড়া অন্য কোনও কাজ করা হয়নি। অথচ ১৯ লাখ ৯৩ হাজার টাকা বিল দেখানো অকল্পনীয়।

নির্বাহী প্রকৌশলীর দেওয়া তালিকার তথ্য অনুযায়ী, বদরগঞ্জ উপজেলার বিষ্ণপুর স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র মেরামতের জন্য ৮ লাখ ৫৪ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। সরেজমিনে এই স্বাস্থ্যকেন্দ্র ঘুরে এবং কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ছোট ছয়টি ভবনের মধ্যে চারটির মেঝে ও অর্ধেক দেয়ালে টাইলস লাগানো ছাড়া অন্য কোনও কাজ করা হয়নি। তবু বরাদ্দের পুরোটাই ব্যয় দেখানো হয়েছে।

এদিকে, ২০১৯ সালে নগরীর নিউ ইঞ্জিনিয়ার পাড়া এলাকায় বিভাগীয় ও জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয় নির্মাণ করা হয়েছিল। ভবন এবং এর জিনিসপত্র নতুন হওয়া সত্ত্বেও মেরামত ও সংস্কারকাজের জন্য ১৯ লাখ ৯৪ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। সব টাকাই ব্যয় দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে ইলেকট্রিক্যাল ক্যাবল ও তিনটি এসি সার্ভিসিংয়ের জন্য চার লাখ ৬৪ হাজার টাকা ব্যয় দেখানো হয়।

এ ব্যাপারে বিভাগীয় পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা দেওয়ান মোরশেদ কামাল বলেন, ‘এটি নতুন ভবন। ভবনের ভেতরে-বাইরে রঙ, তিনটি এসি সার্ভিসিং, কিছু চেয়ার-টেবিল মেরামত ছাড়া অন্য কোনও কাজ করা হয়নি। এজন্য কত টাকা বরাদ্দ ছিল, তা আমার জানা নেই। তবে ১৯ লাখ ৯৪ হাজার টাকার কাজ হয়েছে, এটি আমি আপনার কাছে শুনলাম। আমার মনে হয় না, এত টাকার কাজ করা হয়েছে।’

বিভাগীয় এই কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এসি সার্ভিসিংয়ের জন্য চার লাখ ৬৪ হাজার টাকা ব্যয় দেখানো অবিশ্বাস্য। দুই-তিন বছর আগে এসব এসি লাগানো হয়েছিল। তিনটি এসির সার্ভিসিং খরচ কীভাবে এত টাকা হয়। অবশ্যই সংস্কারের নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ লোপাট করেছেন দায়িত্বশীলরা।

সার্বিক বিষয়ে জানতে তিন দিন নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সাহাবুল আলমের কার্যালয়ে গিয়ে তার দেখা পাওয়া যায়নি। গত মঙ্গলবার এবং বুধবার বেলা ১১টায় তার কার্যালয়ে গেলে অফিস সহকারী জানান, স্যার বাইরে আছেন। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার দুপুরে একাধিকবার তার মোবাইল নম্বরে কল দিলেও রিসিভ করেননি।