হিলি দিয়ে কমেছে যাত্রী পারাপার, রাজস্ব নেমেছে ৬০ হাজারে

ভিসা জটিলতার কারণে দিনাজপুরের হিলি ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট দিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মাঝে পাসপোর্টধারী যাত্রী যাতায়াত উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। মেডিক্যাল ও স্টুডেন্ট ভিসায় সীমিত যাত্রী পারাপার হলেও ভিসা না পাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন ব্যবসায়ীসহ ভ্রমণপিপাসুরা। এতে কমেছে রাজস্ব আহরণ। তবে ট্যুরিস্ট ও বিজনেস ভিসা চালু হলে যাত্রী যাতায়াত বাড়বে বলে জানিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। 

হিলি ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সড়ক ও রেলপথে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো ও সহজ হওয়ায় কলকাতা, চেন্নাইসহ বিভিন্ন স্থানে পৌঁছানোয় উত্তরাঞ্চলের মানুষের কাছে জনপ্রিয় হিলি ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট। চিকিৎসা, ব্যবসা, শিক্ষা, ভ্রমণসহ নানা কাজে প্রতিদিন এ পথ দিয়ে গড়ে ৭০০ থেকে ৮০০ পাসপোর্টযাত্রী যাতায়াত করতেন। কিন্তু গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর ভিসা দেওয়া বন্ধ করে দেয় ভারত। আগে যাদের ভিসা ছিল, মেয়াদ ছিল তারাই যাতায়াত করতেন এতদিন।

সম্প্রতি সীমিত পরিসরে মেডিক্যাল ও স্টুডেন্ট ভিসা দিলেও বন্ধ রয়েছে বিজনেস ও ট্যুরিস্ট ভিসা। মেডিক্যাল ভিসা দিলেও অনেক ঘুরতে হচ্ছে ও বাড়তি খরচ গুনতে হওয়ায় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে রোগীদের। ভিসা না পাওয়ায় অনেকে যেমন ভারতে ঘুরতে যেতে পারছেন না তেমনি সেদেশে থাকা আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে পারছেন না। বর্তমানে যাত্রী পারাপার কমে ১০০-১৫০ জনে নেমেছে। এতে করে বিপাকে পড়েছেন ইমিগ্রেশনে কর্মরত শ্রমিকরাও। অন্যদিকে ভিসা না পাওয়ার কারণে ভারতে গিয়ে পণ্য কিনতে না পারায় লোকসান গুনতে হচ্ছে আমদানিকারকদের।

ভারত ভিসা না দেওয়ায় আমরা বিপাকে পড়েছি উল্লেখ করে বাংলাদেশি নাগরিক আফজাল হোসেন বলেন, ‌‘ভারত ভিসা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। আগে আমরা অনেকে চিকিৎসার জন্য ভারতে যেতাম। সেটি এখন সম্ভব হচ্ছে না। কিছুদিন হলো মেডিক্যাল ভিসা দিচ্ছে খুব সীমিত পরিসরে। কিন্তু যত নিয়ম সেগুলো পূরণ করতেই অবস্থা খারাপ। তারপরও ঘুরে ঘুরে ভিসা পাচ্ছি না। সময়মতো ভিসা না পাওয়ায় আগে যারা ভারতে চিকিৎসা নিয়েছেন তাদের অনেকে যেতে পারছেন না।’

একই কথা বলেছেন বাংলাদেশি নারগীস আকতার। তিনি বলেন, ‘আমাদের অনেক আত্মীয়-স্বজন ভারতে রয়েছেন। তাদের সঙ্গে দেখা করতে কিংবা বেড়াতে যাবো। কোনোটিই সম্ভব হচ্ছে না। ভারত ভিসা বন্ধ করে রাখায় আমরা যেতে পারছি না। আবার ভারতীয় নাগরিক ঠিকই আমাদের দেশের ভিসা পাচ্ছে। তারা বাংলাদেশে ঘুরে যাচ্ছে। এটি আমাদের সঙ্গে বৈষম্য করছে ভারত।’  

মেডিক্যাল ভিসায় ভারতে যাওয়া সুমন পাল বলেন, ‘আমার দুটি কিডনিই বিকল হয়ে গেছে। সপ্তাহে দুবার ডায়ালাইসিস করতে হয়। আমি এর আগে ভারতে চিকিৎসা করেছিলাম। কিন্তু ভিসা না থাকায় বেশ কিছুদিন যেতে পারিনি। মাঝে স্ট্রোক করে ঢাকায় ১৫ দিন চিকিৎসাধীন ছিলাম। এরপর দীর্ঘ চারমাস ধরে ভিসার জন্য কষ্ট ভোগ করলাম। ৮৭৫ টাকার ভিসা খরচ। অথচ পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা দিতে হয়েছে। ভিসা প্রক্রিয়া সহজ হলে আমাদের মতো রোগীদের জন্য খুব ভালো হয়।’ 

আগে প্রতিদিন ৭০০-৮০০ পাসপোর্টযাত্রী যাতায়াত করতেন উল্লেখ করে ইমিগ্রেশনে কর্মরত শ্রমিক পলাশ হোসেন বলেন, ‘এসব যাত্রীর লাগেজবোঝাইসহ বিভিন্ন কাজ করে বেশ কিছু শ্রমিক জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিন্তু এখন ভারত ট্যুরিস্ট ভিসা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। কমিয়ে দিয়েছে অন্য ভিসাও। এতে এই পথ দিয়ে যাত্রী সংখ্যা নেমে এসেছে ১০০ মধ্যে। ফলে কাজ যেমন কমে গেছে, রোজগারও কমে গেছে।’

ভিসা না পাওয়ায় বেশ সমস্যার মধ্যে আছি বলে উল্লেখ করেছেন হিলি স্থলবন্দরের আমদানিকারক নূর ইসলাম। তিনি বলেন, ‘সরকার পরিবর্তনের পর থেকে ভারত আমাদের ভিসা দিচ্ছে না। আমরা যারা আমদানিকারক, তাদের সরেজমিন পণ্য দেখে কিনতে হয়। তারপর সেগুলো আমদানি করতে হয়। কিন্তু এখন ভিসা না থাকায় ফোনে কথা বলে পণ্য আমদানি করা হচ্ছে। কিন্তু ভারতীয় রফতানিকারকরা ফোনে যে পণ্যের কথা বলছে সেটি রফতানি করছে না। অনেক পণ্য পাঠিয়ে দিচ্ছে। এতে লোকসান গুনতে হয়। ভারত সরকারের প্রতি অনুরোধ, যেন বিজনেস ভিসা দেওয়া হয়। আমরা ভারতে গিয়ে পণ্য দেখে আমদানি করতে চাই।’  

যাত্রী পারাপার অনেক কমে গেছে বলে জানালেন হিলি ইমিগ্রেশন চেকপোস্টের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আগে দুই দেশের মাঝে ৭০০-৮০০ পাসপোর্টযাত্রী যাতায়াত করতেন। পরে ট্যুরিস্ট ভিসা বন্ধ করে দেওয়ায় ও অন্যান্য ভিসা দেওয়ার হার কমানোর ফলে যাত্রী পারাপার কমে গেছে। মূলত ট্যুরিস্ট ভিসা বন্ধ থাকায় যাত্রী পারাপার অনেক কমেছে। ট্যুরিস্ট ভিসা চালুসহ অন্যান্য ভিসা দেওয়ার হার বাড়ানো হলে যাত্রী পারাপারের সংখ্যা বাড়বে। হিলি ইমিগ্রেশন দিয়ে গত আগস্ট থেকে চলতি বছরের এপ্রিল মাস পর্যন্ত ৭০ হাজার ৩৪৬ জন যাত্রী পারাপার করেছেন। যেখানে একই সময়ে সেই সংখ্যা ছিল এক লাখ ৬৫ হাজার ৪৭৫ জন। বর্তমানে ১০০ থেকে ১৫০ জন যাত্রী যাতায়াত করছেন।’ 

যাত্রী পারাপার কমে যাওয়ায় রাজস্ব আহরণও কমেছে বলে জানিয়েছেন হিলি স্থল শুল্ক স্টেশনের রাজস্ব কর্মকর্তা আতিকুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আগে প্রতিদিন আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা ভ্রমণকর বাবদ আদায় হতো। কিন্তু এখন ভিসা সীমিত হওয়ায় যাত্রী সংখ্যা কমে যাওয়ায় প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা ভ্রমণকর আদায় হচ্ছে। তবে ভারত ভিসা দেওয়া শুরু করলে যাত্রী যাতায়াত বেড়ে যাবে।’