উপদেষ্টাকে নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট, জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষককে বরখাস্ত

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. বিধান চন্দ্র রায় পোদ্দারের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করার প্রায় চার মাস পর কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। শনিবার (১৭ মে) জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (ডিপিইও) স্বপন কুমার রায় চৌধুরী স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে এ সিদ্ধান্ত জানানো হয়। ডিপিইও স্বপন কুমার রায় চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

ওই শিক্ষকের নাম মনিবুল হক বসুনীয়া। তিনি রাজারহাট উপজেলার আবুল কাশেম বালিকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। সরকারের বিভিন্ন অন্যায্য সিদ্ধান্তসহ বিভিন্ন সামাজিক অসঙ্গতি নিয়ে তিনি ফেসবুকে নিয়মিত সোচ্চার থাকেন। এর আগে ২০২০ সালে শিক্ষকদের দৈনিক টিফিন ভাতা ৬ দশমিক ৬৬ টাকা দেওয়ার প্রতিবাদ করে তা প্রত্যাহার করে লিখিত আবেদন করেছিলেন।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের স্মারক উল্লেখ করে আদেশে বলা হয়েছে, সহকারী শিক্ষক মনিবুল হক বসুনীয়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসুবকে তার ব্যক্তিগত আইডিতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মহোদয়সহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য পোস্ট করেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ ধরনের পোস্ট করায় সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। তার এমন কার্যকলাপ সরকারি প্রতিষ্ঠানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার নির্দেশিকা-২০১৯ (পরিমার্জিত সংস্করণ) এর ৭ (ঘ) এবং ১০ (৩) (ছ) অনুচ্ছেদের পরিপন্থি হওয়ায় সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ এর ৩ (খ) বিধি অনুযায়ী অসদাচরণের দায়ে অভিযুক্ত করে ওই শিক্ষককে সরকারি চাকরি থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হলো।’

এর আগে চলতি বছরের ২৬ জানুয়ারি চট্টগ্রাম নগরীর সার্কিট হাউসের সভাকক্ষে সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার বলেন, ‘আমি শিক্ষকদের বলবো, যদি সমাজে আপনাদের জন্য যে শ্রদ্ধার আসন আছে, সেটা অটুট রাখতে হয় বা ফিরিয়ে আনতে হয়, তাহলে শিক্ষকতা পেশাকে অর্থমূল্যে বিবেচনা করা যাবে না। অবশ্যই আপনাদের আর্থিক উন্নয়নের জন্য সরকারের উদ্যোগ আছে। কিন্তু যারা মনে করবেন যে, না আমার তো পোষাচ্ছে না, খুব ভালো, তাহলে আপনি প্রাথমিকে থাকবেন না, অন্য পেশায় চলে যান।’

উপদেষ্টার এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় শিক্ষক মনিবুল হক বসুনীয়া ওই দিনই (২৬ ফেব্রুয়ারি) নিজের আইডিতে একটি পোস্ট দেন। দীর্ঘ ওই পোস্টে তিনি লিখেছেন, ‘উপদেষ্টা সাহেব, আপনি কোন কোটায় উপদেষ্টা হয়েছেন তা আমার জানা নেই। আপনার কথাবার্তা একদম ফ্যাসিস্ট আমলের মন্ত্রীদের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে।’ এই পোস্ট দেওয়ার কারণ দেখিয়ে প্রায় চার মাস পর ১৭ মে ওই শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করে শিক্ষা বিভাগ।

এ বিষয়ে ভুক্তভোগী শিক্ষক মনিবুল হক বসুনীয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘উপদেষ্টার অমন বক্তব্যে সাধারণ শিক্ষকরা ক্ষোভে ফুঁসে ওঠেন। আমি শিক্ষকদের সংগঠনে নেতৃত্ব দিই। উপদেষ্টা শিক্ষকদের অবমাননা করে, অসম্মান করে বক্তব্য দিয়েছেন। আমি সেটার প্রতিবাদে শিক্ষকদের পক্ষ নিয়ে বলেছি।’

ফেসবুকে পোস্টের বিষয়ে এই শিক্ষক বলেন, ‘আমি যা পোস্ট করেছিলাম তার সারমর্ম হলো, আপনি (উপদেষ্টা) এভাবে শিক্ষকদের অবমাননা করে কথা বলতে পারেন না। আপনি ডাক্তার মানুষ, নিজের পেশায় ফিরে যান। আমাদের বলতেছেন চাকরি ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশায় যেতে, আপনি আপনার পেশায় ফিরে যান। সেটা ছিল ওই সময়ের কথা। সেটার জন্য এখন কেন আমাকে বরখাস্ত করা হলো সেটা আমার বোধগম্য নয়।’

অধিদফতরের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে এই শিক্ষক বলেন, ‘জুলাই আগস্ট আন্দোলনে আমি সরকারি চাকরি ও জীবনের মায়া না করে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলাম। যারা আমাকে জানেন তারা সবাই বিষয়টি দেখেছেন। একজন ফ্রন্টলাইন যোদ্ধা হিসেবে যদি আমার কণ্ঠরোধ করা হয়, তাহলে এদেশে বাকিদের কী হবে? আমি নিজের জন্য যতটা না শঙ্কিত তার চেয়ে অন্যদের জন্য বেশি শঙ্কিত।’

বরখাস্তের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘এখন যারা আছেন তারা ফ্যাসিস্টের চেয়েও বড় ফ্যাসিস্ট। আমি ২০১৫ সাল থেকে শিক্ষকদের অধিকার নিয়ে লিখি। শিক্ষকদের দাবি আদায়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন সচিবের বিরুদ্ধেও লিখেছি। এমনকি আওয়ামী লীগের সভাপতির (শেখ হাসিনা) বিরুদ্ধেও লিখেছি। সেই আমলে আমার কিছু হয়নি। জুলাই আন্দোলনের পর ভেবেছিলাম, আমরা মুক্তভাবে সমালোচনা করতে পারবো। সেখানে সমালোচনা করতে গিয়ে আমরই কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে। এখন আমার মনে প্রশ্ন জেগেছে, আসলেই কী ফ্যাসিবাদের পতন হয়েছে? যা হোক দেখা যাক, কী হয়।’

এদিকে ফেসবুকে পোস্টের জেরে বরখাস্ত করা হলেও ওই শিক্ষককে কোনও ধরনের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়নি। এমনকি বিষয়টির সত্যতাও যাচাই করেনি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ওই শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ডিপিইও।

ডিপিইও বলেন, ‘ফেসবুকে পোস্ট করা নিয়ে ওই শিক্ষককে আগে শোকজ করা হয়নি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ পাওয়ায় ওই শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এখন তার বিরুদ্ধে মামলা হবে। তখন তার কাছে জবাব চাওয়া হবে।’