ঈদুল আজহার মূল আয়োজনই হয় পশু কোরবানি। যেখানে জবাই করা পশুর মাংস কাটার থাকে আয়োজনের বৃহৎ অংশ জুড়ে। আর এ জন্য প্রয়োজন পড়ে সুদক্ষ কসাইয়ের।
কোরবানির এই ঈদের রাজধানী ঢাকায় সংকট থাকে কসাইয়ের। ফলে প্রতি বছরই উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলো থেকে কসাইরা যান ঢাকায়। যেখানে তাদের বাড়তি উপার্জন হয়, মাত্র ৪/৫ দিনের মধ্যেই তাদের আয় হয় প্রায় লাখ টাকা। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, বাস ও রেলওয়ে তো রয়েছেই, এই সময়টাতে কসাইরা ঢাকায় যাচ্ছেন প্লেনে চড়েও।
দিনাজপুর মাংস ব্যবসায়ী সমিতির হিসাব মতে, প্রতি বছর এই জেলা থেকে প্রায় দুই হাজার কসাই, তাদের সহকারী ও মৌসুমি কসাইরা যান ঢাকায়। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। অনেকেই ইতিমধ্যেই ঢাকায় পৌঁছেছেন। অনেকে আগেভাগেই চুক্তি করেছেন, কোথায়, কোনদিন, কোনবাড়িতে গরুর মাংস কাটবেন তারা। টাকাও কেউ কেউ অগ্রিমও নিয়ে রেখেছেন।
কসাইরা জানান, যারা ঢাকায় যান তাদের থাকা, খাওয়াসহ সব ধরনের প্রয়োজনীয় বিষয়াদির দায়িত্ব যারা পশু কোরবানি দেবেন তাদের। চুক্তি থাকে গরুর দাম হিসাবে। প্রতি হাজারে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। অর্থাৎ যদি পশুর দাম এক হাজার টাকা হয় তাহলে কসাইকে দিতে হবে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। এই দাম যত বাড়বে সেই হারেই কসাইকে পারিশ্রমিক প্রদান করতে হবে। আর যদি দিনাজপুরে তারা মাংস কাটার কাজ করেন তাহলে তাদেরকে দেওয়া হয় হাজার প্রতি ৫০ থেকে ১০০ টাকা। যা দিয়ে তাদের ঠিকভাবে উপার্জন হয় না। ফলে বাড়তি উপার্জনের জন্য তারা প্রতি কোরবানিতেই ঢাকায় যান।
মূলত যারা দিনাজপুর থেকে ঢাকায় যান তারা গত ১৫-২০ বছর ধরেই যাচ্ছেন। ফলে তাদের সঙ্গে যারা কোরবানি দেন তাদের জানা শোনা রয়েছে। সেই হিসেবে ফোনেই চুক্তি হয়ে যায়। কসাইরা একসঙ্গে বেশ কয়েকজনের সঙ্গে চুক্তি করেন। সেটাও আবার দিন হিসেব করে। অর্থাৎ ঈদের দিন, ঈদের পরের দিন কিংবা তার পরের দিন। সেই হিসেবে দরদাম হয়। ঈদের দিন হলে চুক্তিতে অর্থের পরিমাণ বেশি, পরে হলে চুক্তিতে অর্থের পরিমাণ কম। আবার কোন ওজনের পশু সেটার দিকেও কসাইদের আগ্রহ ও চুক্তির বিষয়টি নির্ভর করে।
কসাইরা জানিয়েছেন, তাদের টার্গেট থাকে প্রতি জন যাতে করে এই ৩ থেকে ৪ দিনেই ৩০ হাজার টাকা থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত উপার্জন করতে পারেন। সেই হিসেবে তাদের উপার্জনও হয় বলে জানিয়েছেন তারা।
ইতিমধ্যেই প্রায় সব কসাই ঢাকায় পৌঁছেছেন। যাদের অধিকাংশই এসেছেন প্লেনে। দিনাজপুর থেকে এই সময়টাতে যারা ঢাকায় যান তাদেরকে বাড়তি চাপ নিতে হয় না। কারণ এখন ঢাকা থেকে উত্তরাঞ্চল অভিমুখে যানবাহনে চাপ থাকলেও দিনাজপুর থেকে ঢাকায় যাওয়া যানবাহনগুলোতে চাপ নেই। সেই সঙ্গে অপেক্ষাকৃত অনেক কম মূল্যেই তারা ঢাকায় যেতে পারেন। আবার ফেরার সময়ও একই অবস্থা। ফলে যাওয়া-আসাতে তাদের অর্থের তেমন খরচ হয় না। আবার ঢাকায় যে কদিন থাকবেন তার ব্যয়ভার বহন করে সংশ্লিষ্ট কোরবানি দেওয়া পশুর স্বত্বাধিকারী। ফলে এই কয়দিনের উপার্জন দিয়েই তারা আগামী দেড় থেকে দুই মাস চলতে পারেন। কারণ কোরবানি ঈদের পর মাংসের বাজারে তেমন চাপ থাকে না। বেচাবিক্রিও থাকে না। ফলে কসাইদের আয়-উপার্জনে ভাটা পড়ে।
দিনাজপুর জেলার অন্যতম মাংসের বাজার বসে বাহাদুরবাজার এলাকায়। মূলত এই বাজার থেকেই বেশিরভাগ কসাই যান ঢাকায়। আবার যারা বিভিন্ন স্থান থেকে যায় তাদের মধ্যেও অনেকেই এই বাজারের কসাইদের সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে যায়। এই সংখ্যা প্রতি বছরই বাড়ছে। কাঞ্চন ঘাট বাজার, রেলওয়ে বাজার, রামনগর বাজার, মহারাজা মোড়, গোপালগঞ্জ বাজার, ফুলতলা বাজার, ঝুকুরঝাড়ী বাজার, বিরল বাজার, নিউটাউনসহ বিভিন্ন বাজার থেকে কসাইরা ঢাকায় যান। কেউ পর দিন চলে আসেন, কেউ আসেন দুই দিন পর, আবার কেউ আসেন ৩ থেকে ৪ দিন পর।
বাহাদুরবাজার এলাকার কসাই আজাহার আলী বলেন, ২০১৩ সাল থেকেই আমি ঢাকা যাই। ওখানে কাজ ভালো হয়, দিনাজপুরে তো পরিশ্রমের মূল্য দিতে চায় না। ঢাকাতে ভালো পারিশ্রমিক পাই। আমরা ৪০ জন মিলে প্লেনে ঢাকায় এসেছি। টিকেট ভাড়া ৪৮০০ টাকা। ঢাকাতে আমাদেরকে ৩৫টির মতো গরু জবাই ও মাংস কাটতে হবে। আমাদের দলের সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছে তাতে আমাকে ৮০ হাজার টাকা দেবে। টাকা তো এমনি দেয় না, কাজ করলেই টাকা।
একই বাজারের কসাই ফারুক হোসেন বলেন, ২০০৮ সাল থেকে ঢাকা যাই। অনেক সময় বাসে যাই, রেলওয়েতে যাই, আবার বিমানেও যাই। এবারে আমি বিমানে যাচ্ছি, এর আগেও ৩ বার বিমানে গেছি। ঢাকায় বিভিন্ন জায়গায় কাজ করতে হয়। দল বেধে কাজ করি, যা হয় তা ভাগ করে নিই। কন্ট্রাক্ট থাকে গরু প্রতি, একাই তো কাটা যায় না। এ জন্য দল বেঁধে কাজ করি, প্রতিবারে ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা নিয়ে আসি। অনেক সময় আবার বকসিশও দেয়, সেই টাকা দিয়ে বিমানের ভাড়া দেই। বাহাদুরবাজার থেকে এখন পর্যন্ত ১৩০ জন গেছে, কাঞ্চন ঘাট, নিউটাউন, মহারাজা মোড়, রেলওয়ে বাজার, ফুলতলা, ঝুকুরঝাড়ী বাজার, বিরল বাজার এমন বিভিন্ন জায়গা থেকে কসাইরা যায়। কোরবানির ঈদের পর তো প্রায় তিন মাস ভালো ব্যবসা হয় না। সংসার চালানো, ছেলেমেয়ের স্কুল, খাওয়া-দাওয়াসহ সবকিছু মেটাতে আমাদের এই সময়টাতে যা আয় হয় সেটা দিয়ে নির্বাহ করি। দিনাজপুরে তো মাংস কাটাকাটি করলেও ভালো পারিশ্রমিক পাই না। কিন্তু ঢাকায় ভালো পারিশ্রমিক পাই, সম্মানও করে।
কসাই সোহাগ বলেন, আমার মামা গেছে, একজন ভাই ঢাকায় গেছে। আমাদের দিনাজপুরে যে হারে গরু জবাই হয়, সেই হারে টাকা বা পারিশ্রমিক দেয় না। এ জন্য দিনাজপুরের বিভিন্ন বাজার থেকে ঢাকায় কসাইরা যায়। সেখানে টাকার মান বেশি, বা পারিশ্রমিক ভালো দেয়। খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা থাকে। একেকজন গরু কিনেছে দুই লাখ আড়াই লাখ টাকা মূল্যের। তাতে ভালো পারিশ্রমিক পাওয়া যায়। কোরবানির পর তো টোটালি গরুর ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ঢাকা থেকে যা আয় হয় তা দিয়ে সংসার চালাই। অনেক কসাই বাসে, কেউ ট্রেনে করে যায়। বেশির ভাগই ট্রেনে করে যায়। আবার কেউ কেউ প্লেনে করে যায়। আমার দোকানের একজন কারিগর ঢাকায় যাবে প্লেনে করে।
বাহাদুরবাজার মাংস ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ ভুট্টু ইসলাম বলেন, আমাদের দোকানের একজন ছেলে আজ বিমানে যাবে। কেউ বাসে গেছে, কেউ ট্রেনে গেছে। কোরবানির পর সবাই বসে থাকে। তখন তাদের উপার্জন থাকে না। এ জন্য ঢাকায় যাই, যা উপার্জন হয় তা দিয়ে পরবর্তী সময়গুলো যখন বসে থাকি, তখন চলে। কন্ট্রাক্ট করে যাই ৪০ থেকে ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত। বাহাদুরবাজার থেকেই বেশি কসাই, তাদের সহকারী ও মৌসুমি কসাইরা ঢাকায় যায়। আবার জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে যায়। মোবাইলে করেই চুক্তি হয়, তারপর কসাইরা যায়। একেকজন একেকটি দল করে মাংস কাটতে যায় ঢাকায়। আগে যেমন কসাই যেতো, এখন দিন দিন যাওয়ার সংখ্যা বাড়ছে। পুরো জেলা থেকে প্রায় দুই হাজার কসাই, তাদের সহকারী ও মৌসুমি কসাইরা ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন।