২০০৫ সালের ৭ জানুয়ারি ও ২৪ জুন কানাডিয়ান কোম্পানি নাইকো সুনামগঞ্জের ছাতক গ্যাসফিল্ডের টেংরাটিলা গ্যাসকূপে রিলিফ ওয়েল করতে গিয়ে ব্লো আউটের ঘটনায় দুই দফা আগুন লাগে। অগ্নিকাণ্ডে তিন হাজার একর ফলের বাগান, শতাধিক পুকুরের মাছ ও সবজি বাগান নষ্ট হয়ে যায়।
জেলা সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালের আগস্ট মাসের প্রতিবেদনে টেংরাটিলা কূপ খননের সময় গ্যাস ব্লো আউটের ফলে প্রতিকূল স্বাস্থ্যগত প্রভাব বিষয়ক প্রতিবেদনে দেখা যায়, শ্বাসকষ্ট জনিত রোগে ৪৫ জন, হৃদরোগে ২২ জন ও চর্মরোগে ৩৬ জনসহ অন্যান্য রোগে ২২ জনসহ মোট ১২৯ জন আক্রান্ত হয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে এসব রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আরও বেশি।
টেংরাটিলা কমিউনিটি ক্লিনিকের কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি ) মরিয়ম আক্তার জানান, প্রতিদিন ক্লিনিকে শ্বাসকষ্ট ও আর্সেনিকজনীত রোগে আক্রান্ত হয়ে বিপুল সংখ্যক রোগী আসেন। গেল মাসে তিনি ৭০০ জন রোগীর চিকিৎসা দিয়েছেন, যাদের মধ্যে তিনশতাধিক রোগী হলেন শ্বাসকষ্ট, চর্মরোগ ও আর্সেনিকে আক্রান্ত। প্রয়োজনীয় ওষুধপত্রের সরবরাহ না থাকায় লোকজনের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।
জেলার ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা. গৌতম রায় স্বাস্থ্য বিভাগে জনবল সংকটের কারণে আক্রান্তদের চিকিৎসা সেবা ব্যহত হচ্ছে বলে জানান, গ্যাসফিল্ড এলাকার আশপাশে এখনও লোকজন শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগ ও চর্মরোগসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।
গ্যাসফিল্ড সংলগ্ন আজবপুর গ্রামের গৃহিনী আছমা আক্তার জানান, তাদের বাড়ির টিউবওয়েলে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক থাকায় পানি ব্যবহার করার ফলে হাত খসখসে হয়ে যায়, মাথার চুল পড়ে যায়। এছাড়া ওই পানি দিয়ে কাপড়চোপর ধোয়ার ফলে কাপড়ের রংও বদলে যায়।
গিরিশনগর গ্রামের আর্সেনিকে আক্রান্ত মো. মনির হোসেন জানান, তিনি ১০/১২ বছর হলো আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়েছেন। বর্তমানে কোনও কাজকর্ম করতে পারে না। বিভিন্ন স্থানে চিকিৎসা করে ১০/১৫ লাখ টাকা ব্যয় করেছেন কিন্তু রোগ ভালো হচ্ছে না।
একই গ্রামের কালুমিয়ার স্ত্রী ফয়জুনেচ্ছা জানান, তিনি ৪/৫ বছর ধরে শ্বাস কষ্টে ভোগছেন। সরকারিভাবে কোন ওষুধপত্র পান না। ডাক্তার দেখানো ও ওষুধের খরচ নিজেকেই বহন করতে হচ্ছে।
রোকেয়া আক্তার (৪০) নামে স্থানী একজন জানান, দীর্ঘদিন ধরে তিনি পেটের পীড়ায় ভুগছেন, এখনও ওষুধ খেয়ে যাচ্ছেন।
আর্ন্তজাতিক আদালতে দায়ের করা নাইকো ক্ষতিপূরণ মামলার অন্যতম সাক্ষী ও টেংরাটিলা উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসর প্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. ফরিদ উদ্দিন আহম্মদ বলেন, অগ্নিকাণ্ডের ফলে গ্যাসফিল্ড সংলগ্ন ১০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে এর প্রভাব পড়ে। অগ্নিকাণ্ডে জানমাল পশুপাখি সব কিছুর ক্ষতি সাধিত হয়। এখনও গ্যাসফিল্ডের আশপাশের এলাকায় কোন গাছপালা জন্ম লাভ করে না। কোন গাছের চারা লাগানো হলে বছর খানেক জীবিত থাকে পরে আবার মরে যায়। এখানে কোন ফসল হয় না। অনিয়ন্ত্রিতভাবে গ্যাস উদগীরনের ফলে লোকজন অসুস্থ হচ্ছে।
স্থানীয় ৯ নম্বর সুরমা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান খন্দকার মো. মামুনুর রশীদ এলাকায় বিশুদ্ধ পানীয় জলের সংকটের কথা স্বীকার করেছেন। তিনি টেংরা টিলা গ্যাসফিল্ড পুনরায় খননের দাবি জানান।
সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের জুনিয়র কনসালটেন্ট ডা. বিষ্ণু প্রসাদ চন্দ বলেন, টেংরাটিলা গ্যাসফিল্ডে অনিয়ন্ত্রিতভাবে যে গ্যাস বের হচ্ছে, এটা জনস্বাস্থ্যের জন্য খুবই ঝুকিপূর্ণ। এভাবে গ্যাস বের হতে থাকলে গ্যাসফিল্ড এলাকার মানুষের চোখে ঝাপসা দেখা, শ্বাসকষ্ট ও চর্মরোগ হতে পারে।
সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগী প্রধান ইফতেখার আলম বলেন, ‘টেংরাটিলা এলাকার জনবসতির নির্দিষ্ট একটি পেশা ছিল। আজ মানুষের সৃষ্ট দুর্যোগের কারণে মানুষ পেশাচ্যুত হয়ে গেছে।’
জেলা প্রশাসক শেখ রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘টেংরাটিলা গ্যাসফিল্ডের সার্ভিক অবস্থা প্রশাসন সরকারকে অবহিত করেছে। কিছু গ্যাস বুদবুদ আকারে বের হচ্ছে।’
/এমডিপি/