সিলেটে বেড়েছে শীতজনিত ডায়রিয়া, বেশি ভুগছে শিশুরা

শীতে কাঁপছে সিলেট। মাঘের শুরু থেকে দেশের উত্তর-পূর্ব এই জেলায় বয়ে চলছে শৈত্যপ্রবাহ। প্রতিদিন বাড়ছে দাপট। কমছে তাপমাত্রা। এ অবস্থায় জেলায় শীতজনিত নানা রোগে শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা বেড়েছে। হাসপাতালগুলোতে নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কিওলাইটিস, অ্যাজমা, শ্বাসকষ্ট ও ডায়রিয়াসহ শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি। এর মধ্যে বেশিরভাগ শিশু।

সিলেটের এম এ জি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে আসা রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরা। জেলার ১৩ উপজেলায় শীতজনিত রোগে আক্রান্ত শিশুসহ অন্যান্য বয়সীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে ১৩৭টি মেডিক্যাল টিম। 

ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, গত ডিসেম্বর থেকে বৃহস্পতিবার (১৮ জানুয়ারি) পর্যন্ত সিলেটে অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ইনফেকশন (এআরআই) বা শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহজনিত রোগে কানাইঘাটে একজন ও গোয়াইনঘাটে একজনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া শীতজনিত রোগে কারও মৃত্যু হয়নি।

গত ২৪ ঘণ্টায় জেলার ১৩ উপজেলায় শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে ২৭ জন চিকিৎসাধীন রয়েছে। একই সময়ে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে ৫৯ জন। গত ১০ ডিসেম্বর থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত শিশুসহ বিভিন্ন বয়সী এক হাজার ১২২ জন একই রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছে। এই সময়ে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছে দুই হাজার ২৮৬ জন। এর মধ্যে সদরে ২২, দক্ষিণ সুরমা উপজেলায় ৫৭, বিশ্বনাথে ১৫১, বালাগঞ্জে ১৫৪, ওসমানীনগরে ৩৪, ফেঞ্চুগঞ্জে ২৬০, গোলাগঞ্জে ১৮৭, বিয়ানীবাজারে ৯৯, জকিগঞ্জে ৩৪৩, কানাইঘাটে ৩৪৩, গোয়াইনঘাটে ২০০, জৈন্তাপুরে ২৮২ ও কোম্পানীগঞ্জে ১৫১ জন চিকিৎসাসেবা নিয়েছে। 

বৃহস্পতিবার বিকালে হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, মেডিসিন ও শিশুসহ সব ওয়ার্ড রোগীতে পরিপূর্ণ। এ সময়ে হাসপাতালের বহির্বিভাগেও রোগীদের ভিড় দেখা যায়। তাদের মধ্যে বেশিরভাগ শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তি। জ্বর-সর্দি, কাশি ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত অনেকে।

সেবা দিয়ে যাচ্ছে ১৩৭টি মেডিক্যাল টিম

আক্রান্তদের সেবা দেওয়ার জন্য স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ বিভিন্নভাবে সেবা দিয়ে যাচ্ছে ১৩৭টি মেডিক্যাল টিম। এর মধ্যে সিলেট সদরে ১০, দক্ষিণ সুরমা উপজেলায় ৯, বিশ্বনাথে ১১, বালাগঞ্জে ৭, ওসমানীনগরে ৮, ফেঞ্চুগঞ্জে ১০, গোলাগঞ্জে ১৬, বিয়ানীবাজারে ১৬, জকিগঞ্জে ১০, কানাইঘাটে ১২, গোয়াইনঘাটে ১০, জৈন্তাপুরে ১১ ও কোম্পানীগঞ্জে সাতটি মেডিক্যাল টিম কাজ করে যাচ্ছে।

শীতের তীব্রতা বাড়ায় শিশু ও বয়স্করা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে উল্লেখ করে সিলেটের ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. জন্মেজয় দত্ত বলেন, ‘শীতজনিত রোগে আক্রান্ত শিশুসহ বিভিন্ন বয়সীদের সেবা দেওয়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছে সিভিল সার্জন কার্যালয়ের আওতাধীন ১৩৭টি মেডিক্যাল টিম। আক্রান্তের মধ্যে শিশু ও বয়স্কদের সংখ্যা বেশি। ইতোমধ্যে শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে কানাইঘাটে একজন ও গোয়াইনঘাটে আরেকজনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া ঠান্ডাজনিত রোগে কারও মৃত্যু হয়নি।’

সতর্ক থাকতে বলেছেন চিকিৎসকরা

শীত, কুয়াশা, আবহাওয়ার পরিবর্তন ও বায়ুদূষণসহ অসচেতনতার কারণে বিভিন্ন ধরনের রোগ বেড়ে যায় জানিয়ে ডা. জন্মেজয় দত্ত বলেন, ‘এ সময় অবশ্যই সবার মাস্ক পরে চলাচল করা উচিত। একইসঙ্গে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। এই সময়ে যে কেউ ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এসব রোগ থেকে রেহাই পেতে গরম কাপড় ব্যবহার, যতটা সম্ভব ঠান্ডা পরিবেশ এড়িয়ে চলা জরুরি। শিশুদের ঠান্ডা বাতাস থেকে দূরে রাখা, সেইসঙ্গে ধুলাবালু থেকে যতটা সম্ভব দূরে রাখতে হবে। শৈত্যপ্রবাহ চলাকালে শিশুদের ঘর থেকে কম বের করতে হবে। ঘরের মধ্যে ঠান্ডা বাতাস যেন না ঢোকে, সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে।’ 

ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. সৌমিত্র চক্রবর্তী বলেন, ‘শীতে বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়। এজন্য প্রথমে প্রয়োজন সতর্কতা। হাসপাতালে শিশু, মেডিসিন ওয়ার্ডসহ প্রায় সবকটি ওয়ার্ডে রোগীর চাপ বেশি। বেশিরভাগই শীতজনিত রোগে আক্রান্ত। এর মধ্যে শিশুর সংখ্যা বেশি। আমরা আন্তরিকভাবে চিকিৎসা দিচ্ছি। শীতজনিত রোগ থেকে বাঁচতে অবশ্যই শীত এড়িয়ে চলা ছাড়া বিকল্প নেই।’

সিলেট উইমেন্স মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের চিকিৎসক নাজমিন বেগম বলেন, ‘শীতে শিশু ও বয়স্ক; উভয়ে শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহজনিত রোগে আক্রান্ত হয়। কারণ দুই বয়সেই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কিওলাইটিস, অ্যাজমা, শ্বাসকষ্ট ও ডায়রিয়াসহ শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন রোগ থেকে শিশু ও বয়স্কদের রক্ষা করতে পর্যাপ্ত গরম কাপড়, হাত-মোজা, পা-মোজা পরিয়ে রাখতে হবে।’

শিশু ও বয়স্কদের প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের না করার পরামর্শ

শীতের তীব্রতা বাড়ায় শিশু ও বয়স্কদের প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের না করার পরামর্শ দিয়ে চিকিৎসক নাজমিন বেগম আরও বলেন, ‘সর্ব অবস্থায় কুসুম গরম পানি ব্যবহার করতে হবে। তারপরও যদি কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ে, শ্বাসকষ্টে ঘুমাতে না পারে, ঠোঁট-মুখ নীল হয়ে যায়, শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি ওঠানামা করে, তাহলে অবশ্যই রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে এসে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।’

বৃহস্পতিবার সিলেটের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১০ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা চলতি মৌসুমের মধ্যে সবচেয়ে কম বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর।

সিলেট আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তা আব্দুল মুহিত বলেন, ‘সিলেটে প্রতিদিনই তাপামাত্রা কমছে। বৃহস্পতিবার মৌসুমের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল জেলায়। আরও কয়েকদিন শৈত্যপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে। গত পাঁচ দিন ধরে তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রির ওপরে উঠছে না। এজন্য তীব্র শীত অনুভূত হচ্ছে।’