বিতর্কিত তথ্য থাকায় মাদ্রাসার চার বই বাতিল: সরকারের ১৪ কোটি টাকা গচ্চা

মাদ্রাসা-বোর্ডের-চারটি-বই
বিতর্কিত তথ্য থাকায় দেশের মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চারটি বই বাতিল করা হয়েছে। এই বইগুলো হলো–২০১৮ সালের জন্য ছাপানো সপ্তম শ্রেণির ‘আল্ আকায়েদ ওয়াল ফিক্‌হ’, অষ্টম শ্রেণির ‘আল্ আকায়েদ ওয়াল ফিক্‌হ’ নবম ও দশম শ্রেণির ‘কুরআন মাজিদ ও তাজভিদ’ ও ‘হাদিস শরিফ’। বাতিলের পর বইগুলো সংশোধন করে পাঠানো হচ্ছে সারা দেশের মাদ্রাসাগুলোয়। এই চারটি বই বাতিল, সংশোধন ও পুনর্মুদ্রণের ফলে সরকারের মোট ১৪ কোটি ২০ টাকা গচ্চা গেলো। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এনসিটিবি সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের সেপ্টেম্বরে মাদ্রাসার সব বই জেলা-উপজেলা পর্যায়ে পাঠানো হয়েছিল। এরমধ্যে এই চার শ্রেণির চার বিষয়ের মোট বই সংখ্যা ২৩ লাখ ৮৯ হাজার ৭৭৬ কপি। যার সবই পৌঁছে গিয়েছিল জেলা-উপজেলা পর্যায়ে। পরে বই চারটিতে ইসলামের অবমাননাসহ ব্যাঙ্গাত্মক তথ্য রয়েছে বলে অভিযোগ তোলেন সংশ্লিষ্টরা। এরপর নভেম্বরের মাঝামাঝি সময় জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের মেইল করে বইগুলো ফেরত নেওয়ার নির্দেশ দেয় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। ফেরত পাওয়ার পর বইগুলো পুনর্মুদ্রণ করে পাঠানো হয় মাদ্রাসাগুলোতে।

26234375_1412744312168257_846398616_nএনসিটিবির সদস্য মিয়া এনামুল হক বলেন, এই চারটি বই একবার ছাপাতে সরকারের খরচ হয়েছে প্রায় সাড়ে ১৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা। আর দেশের সব জেলা ও উপজেলা থেকে এই বই চারটি ফেরত আনতে আরও খরচ হয়েছে ৮০ লাখ টাকা। এতে মোট গচ্চা গেছে ১৪ কোটি ২০ লাখ টাকা।

এই চার শ্রেণির চার পাঠ্যবইয়ে ইসলামের অবমাননাসহ ব্যাঙ্গাত্মক তথ্য রয়েছে বলে অভিযোগ তোলেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক শামীম মোহাম্মদ আফজাল। এরপর তিনি মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক একেএম ছায়েফ উল্যাহকে চিঠি দিয়ে বিষয়টি জানান। বইগুলোর অন্তত ১৫টি জায়গায় ইসলাম অবমাননাকর এবং ব্যাঙ্গাত্মক তথ্য দেওয়া হয়েছে বলে চিঠিতে বলা হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক শামীম মোহাম্মদ আফজাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ভুল হতেই পারে। সরকার সেটা সংশোধন করছে, ভালো কথা।’ তবে এ বিষয়ে মাদ্রাসা ও কারিগরি বিভাগের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বললে তারাই ভালো বলতে পারবেন বলে জানান তিনি।

26551269_1412744315501590_393494438_n

ইতোমধ্যে বাতিল হওয়া ও নতুন মুদ্রিত বইগুলো বাংলা ট্রিবিউনের হাতে এসেছে। বাতিল করা নবম-দশম শ্রেণির ‘হাদিস শরিফ’ বইয়ের ৫৩ নম্বর পৃষ্ঠার একটি বাক্যে ‘তুমি কি তোমার মাকে বিবস্ত্র অবস্থায় দেখতে পছন্দ কর?’ এই বাক্যটিতে ‘বিবস্ত্র’ শব্দটি নিয়ে আপত্তি জানানোর পর নতুন করে ছাপানো বইয়ে ওই বাক্যটি লেখা হয়েছে, ‘তুমি কি তোমার মাকে অসম্পূর্ণ পোশাকে (অনাবৃত) দেখতে পছন্দ করো?’ বাতিল করা একই বইয়ের ১৭৯ নম্বর পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছে,‘আক্কেলপুর গ্রামে কাজি ও শেখ বংশের লোকদের মধ্যে দীর্ঘ কলহের পর গতকাল মারামারি হলো।’ পরে  নতুন করে ছাপা বইটিতে ‘শেখ বংশের’ জায়গায় ভূঞা বংশ লেখা হয়েছে। একইভাবে বাতিল হওয়া বইয়ের ৩২৮ নম্বর পৃষ্ঠার প্রথম প্যারার শেষ দিকে, ‘প্রথমত মদকে একটি নেয়ামত ও আকর্ষণীয় পানীয় হিসেবে পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে’ বলে লেখা হয়েছে। পরে নতুন পুনর্মুদ্রিত বইতে এই বাক্যটি ফেলে দেওয়া হয়েছে।

বাতিল হওয়া নবম-দশম শ্রেণির ‘কুরআন মজিদ ও তাজভিদ’ বইয়ের ১৭৮তম পৃষ্ঠায় ২৮তম পাঠ/রুকুতে সহবাস নিয়ে ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে। যা সংশোধিত মুদ্রণে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। একই বইয়ের ৪২৪ নম্বর পৃষ্ঠায় নারীদের নেতা হওয়াকে নিষিদ্ধ উল্লেখ করা হয়। যা সংশোধিত বই থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

দাখিল স্তরের অষ্টম শ্রেণির ‘আল্‌ আকায়েদ ওয়াল ফিক্‌হ’ বইয়ের ৬৬ পৃষ্ঠায় বলা হয় ‘আল কুরআন মুসলমানদের সংবিধান’। পরে নতুন মুদ্রিত বইয়ে এই লাইনটি ফেলে দিয়ে ছাপা হয়েছে, ‘আল কুরআন সঠিক পথের নির্দেশক’। এছাড়া দাখিল স্তরের সপ্তম শ্রেণির ‘আল আকায়েদ ওয়াল ফিক্হ’ বইয়েও বিভিন্ন জায়গায় ভুল তথ্য ও বিকৃত করায় তাও বাতিল করে নতুন করে ছাপানো হয়েছে। 

26196719_1412744318834923_1632324073_n

এনসিটিবি কর্তৃপক্ষ বলছে, মাদ্রাসার বইগুলো রচনা থেকে শুরু করে ছাপানো বাদে বাকি কাজ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি, মাদ্রাসা বিভাগ ও মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড। পাণ্ডুলিপির সিডি এনসিটিবিতে পাঠালে সংস্থাটি কেবল বই ছেপে দেয়। ফলে এই বইয়ের ভুল থাকা ও নতুন করে ছাপার দায় এনসিটিবির নয়। 

জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাদ্রাসা ও কারিগরি বিভাগ থেকে চিঠি দিয়ে বলা হয়, মাদ্রাসার সপ্তম, অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণির মোট চারটি পাঠ্যবই সংশোধন করে আবার ছেপে দিতে হবে। আমরা সেই কাজটিই করেছি। এর বাইরে আমাদের আর কিছু জানা নেই।’

অন্যদিকে মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান একেএম ছায়েফ উল্যাহ সম্পূর্ণ দোষ চাপালেন এনসিটিবির ওপর। তিনি বাংলা ট্রিবিউন বলেন, ‘আমি এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারবো না। যারা বইগুলোর লেখক, সম্পাদক, তারা ন্যাশনাল কারিকুলাম কো-অর্ডিনেশন কমিটির অনুমোদন নিয়ে বই রচনা করে এনসিটিবিতে যায়। এনসিটিবি’র সব লোকের সঙ্গে জড়িত আছে। এই বইগুলো এনসিটিবি পরিমার্জন করে তবেই মুদ্রণে দেয়। ফলে যা হয়েছে, এ বিষয়ে এনসিটিবিই ভালো বলতে পারবে। এছাড়া এই বিষয়টি এখন ডেড (মৃত) ইস্যু।’ বিষয়টি নিয়ে কথা বলে লাভ কী—এমন প্রশ্ন রেখেই তিনি তিনি ফোন রেখে দেন। 

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের সচিব মো. আলমগীর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মাদ্রাসার এই চারটি বই সংশোধনের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশ এসেছিল। এই কারণেই নতুন করে বইগুলো সংশোধন করা হয়েছে।’  এ বিষয়ে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও তিনি জানান।