মোনাস কলেজের স্টাডি সেন্টার কি কোচিং সেন্টার?

বাংলাদেশে পরিচালিত বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাস বা স্টাডি সেন্টারে বিদ্যমান বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। শুধু তাই নয়, যে বিধিমালা অনুসারে বিদেশি কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাস বা স্টাডি সেন্টার দেশে স্থাপন ও পরিচালনার অনুমতি দেওয়া হয়েছে; সেই বিধিমালাও আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

অপরদিকে, দেশের ১০৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষার সকল সেক্টর অলাভজনক করা হয়েছে। অথচ কোচিং সেন্টারগুলো লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে। এতে করে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টাডি সেন্টার মানেই কি কোচিং সেন্টার?

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ২৫ ফেব্রুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ অস্ট্রেলিয়ার মোনাস কলেজের স্টাডি সেন্টার স্থাপনের অনুমোদন দেয়। এরপর স্টাডি সেন্টারটির আইনগত ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলে বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি।    

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য অধ্যাপক ড. আলমগীর বলেন,  ‘এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশে বিদেশি স্টাডি সেন্টারের কার্যক্রম পরিচালনার কোনও সুযোগ নেই। তাদের সকল কর্মকাণ্ড ইউজিসির কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হবে।’

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে,  ২০১০ সালের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আইন, সেই আইনে স্পষ্ট বলা আছে— বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাস বা স্টাডি সেন্টার করার জন্য বিধি তৈরি করতে হবে। ২০১৪ সালের বিধিমালাটি আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনও বিধিমালা তৈরি করা যায় না। এই কারণেই সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সময় ও বর্তমান মন্ত্রী ডা. দীপু মনির সময়ের প্রথম দিকে কেউ স্টাডি সেন্টার খুলতে পারেনি। 

জানা গেছে, ২০১৪ সালের বিধিমালা সংশোধন করতে মন্ত্রণালয় একটি কমিটি করে দেয়। ওই কমিটি ২০২০ সালের জানুয়ারিতে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দাখিল করে। এরপর ওই বছরের মার্চে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে কমিটি যে সুপারিশ করেছে, তা সংশোধন করে নতুন করে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা বলা হয়। তারপর থেকেই শুরু হয় করোনা মহামারি। এরই মধ্যে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি অস্ট্রেলিয়ার মোনাস কলেজের স্টাডি সেন্টারের অনুমোদন দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. মো আলমগীর বলেন, ‘করোনার সময় স্টাডি সেন্টার আমাদের অগ্রাধিকারের মধ্যে পড়ে না। এখন আমাদের অগ্রাধিকার শিক্ষা কার্যক্রম। তাছাড়া মোনাস কলেজের যে স্টাডি সেন্টার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, সেটা অনেকটা কোচিং সেন্টারের মতো। মোনাস বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য শিক্ষার্থীরা এখানে কোচিং করে যোগ্যতা অর্জন করবে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইউজিসির একজন সদস্য বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মোনাস কলেজের স্টাডি সেন্টারের যে বিজ্ঞাপন পত্রিকায় দেওয়া হয়েছিল, তা দেখলেই বোঝা যাবে যে সেটি আসলে কোচিং সেন্টার।’

স্টাডি সেন্টার লাভজনক প্রতিষ্ঠান

দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অলাভজনক হলেও বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজের স্টাডি সেন্টার পরিচালনা লাভজনক। এ নিয়েও বিতর্ক তোলেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি সম্প্রতি বলেছেন, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সরকারের সহযোগী।’ 

অপরদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সরকারের কাছে সুদমুক্ত ঋণ চেয়ে পায়নি। ইউজিসির পক্ষ থেকে লোক দেওয়ার বিষয়ে মৌখিক সুপারিশ থাকলেও তা কাজে আসেনি। অথচ বিদেশি স্টাডি সেন্টার পরিচালনা করে উদ্যোক্তা বা মালিক পক্ষ লভ্যাংশ নিয়ে যেতে পারবেন।    

বিদেশি স্টাডি সেন্টার আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি জানায়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ অনুযায়ী, বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ‘ট্রাস্ট আইন, ১৮৮২’ অধীনে অলাভজনক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত হয়। এক্ষেত্রে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রতিষ্ঠানের শাখা ক্যাম্পাস বা স্টাডি সেন্টার ‘কোম্পানি আইন, ১৯৯৪’ এর অধীনে লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে অনুমোদন দেওয়ায় কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

লভ্যাংশ পাবেন উদ্যোক্তা

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ -এর ৪৪(৭) ধারা অনুযায়ী,  ‘কোনও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ তহবিলের অর্থ উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয় ব্যয় ছাড়া অন্য কোনও উদ্দেশ্যে ব্যয় করা যাবে না’। অথচ বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস বা স্টাডি সেন্টার ২০১৪ সালের বিধি ৭ (ঝ) অনুযায়ী, ‘উদ্বৃত্ত অর্থ-সম্পদ উদ্যোক্তা, স্থানীয় প্রতিনিধি ও বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আনুপাতিক হারে বণ্টন হবে।’

বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেন বলেন, ‘উচ্চশিক্ষা খাতে এ জাতীয় দ্বৈতনীতি কার্যকর হলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উদ্যোক্তারা নিরুৎসাহিত হয়ে পড়বেন। বৈষম্যমূলক বিধির আওতায় সহজ শর্তে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর লাভজনক শাখা ক্যাম্পাস পরিচালনার অনুমোদন কার্যকর হলে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হবে। সম্ভাবনাময় অনেক বিশ্ববিদ্যালয় স্বল্প সংখ্যক শিক্ষার্থীর বিপরীতে পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিশাল অঙ্কের ব্যয় মেটাতে গিয়ে বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। এ ছাড়া উচ্চশিক্ষা খাতে বৈদেশিক মুদ্রা পাচার রোধের বিপরীতে নিম্নমানের বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম সর্বস্ব ক্যাম্পাস পরিচালনার মাধ্যমে সনদ বাণিজ্যের আশঙ্কা রয়েছে।

ভুয়া স্টাডি সেন্টার

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির চেয়ারম্যানের এই বক্তব্যের কিছুদিন পর ইউজিসি দেশে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘লন্ডন স্কুল অব কমার্স ঢাকা (এলএসসি)’ নামের ভুয়া স্টাডি সেন্টার খুঁজে পায় ইউজিসি।

ভুয়া  স্টাডি সেন্টারের সন্ধান পাওয়ার পর গত ৯ মার্চ ঢাকায় ‘ভুয়া স্টাডি সেন্টার’  বন্ধে সরকারের প্রতি আহ্বান জানায় ইউজিসি। ওই সময় ইউজিসির বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ভুয়া প্রতিষ্ঠানটি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে মাস্টার্স প্রোগ্রামের জন্য পাঁচ হাজার এক শ’ এবং পিএইচডি প্রোগ্রামের জন্য ১০ হাজার ছয় শ’ ডলার করে নিচ্ছে।

ওই সময় ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রত্যাশীদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন।