এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। আজ বেলা ১১টায় ফল প্রকাশের পর উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা। সন্তানরা ভালো করায় খুশি অভিভাবকরা। তবে শিক্ষার্থী ও অভিভাবক সবার মধ্যেই ট্রমা রয়ে গেছে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের।
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এ বছর মোট পরীক্ষা দিয়েছে ২৫৫৯ জন শিক্ষার্থী। পাস করেছে ২৫৩৫ জন, ফেল করেছে ২৪ জন। মোট পাশের হার ৯৯.০৬ শতাংশ। জিপিএ ৫ পেয়েছে ১৭৩৭ জন।
ফল প্রকাশের পর নিউ বেইলি রোডের কলেজে ভিড় করেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। কাঙ্ক্ষিত রেজাল্টের খুশিতে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরেন তারা। সবার চোখে-মুখে স্বস্তির হাসি। শিক্ষার্থীরাও নেচে-গেয়ে উদযাপন করছিল বিশেষ মুহূর্তটা। তবে এই খুশির পেছনের গল্পটা ছিল অনিশ্চয়তা, ভয় আর আতঙ্কের।
এবার এইচএসসি বা সমমানের পরীক্ষা শুরু হয়েছিল গত ৩০ জুন। সাতটি পরীক্ষা হওয়ার পর সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। এমন পরিস্থিতিতে কয়েক দফায় পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। তখন পর্যন্ত ছয়টি বিষয়ের পরীক্ষা বাকি ছিল। একপর্যায়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন সরকার পতনের এক দফায় রূপ নেয়। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। পরে ১১ আগস্ট থেকে নতুন সময়সূচিতে পরীক্ষা নেওয়ার কথা বলা হলেও তা বাতিল করা হয়।
অভিভাবক, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আন্দোলনের সময়কার দুঃসহ স্মৃতি এখনও তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাদের। পরীক্ষার মাঝপথে দেশের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় ছিল অনিশ্চয়তা। পাশাপাশি রাজপথে থাকা শিক্ষার্থীরা আর পরীক্ষার হলে ফিরবে কিনা চিন্তা ছিল শিক্ষকদের। পড়াশোনায় মনোযোগ ছিল না শিক্ষার্থীদের।
অভিভাবক জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, ‘পরীক্ষা চললেও মেয়েকে আটকে রাখা যায়নি। প্রতিদিনই আন্দোলনে গেছে। চিন্তা ছিল যদি আঘাত পায়। আর অনেক বাচ্চা মারা যাচ্ছিল। সব মিলিয়ে ভয় তো ছিলই। মেয়েও একটা ট্রমার মধ্যে চলে গিয়েছিল। আমার নিজের আতঙ্ক তো এখনও কাটেনি। আলহামদুলিল্লাহ রেজাল্ট ভালো হয়েছে। সব মিলিয়ে চিন্তামুক্ত লাগছে।’
আরেক অভিভাবক তাহমিনা ইসলাম বলেন, ‘প্রতিদিন মৃত্যুর খবর আসছিল। এই অবস্থায় মেয়ের পরীক্ষা চলেছে, আবার বিবেকের কারণে আন্দোলনে যাওয়াও ঠেকাতে পারছিলাম না। চিন্তা ছিল বাকি পরীক্ষাগুলো হবে কিনা। মেয়ের মধ্যে একটা ট্রমা কাজ করছিল। কিন্তু রেজাল্ট ভালো হওয়ায় এখন নির্ভার।’
নজরুল ইসলাম নামে আরেক অভিভাবক বলেন, ‘যে পরিস্থিতি ছিল তাতে সবগুলো পরীক্ষা হওয়া কঠিন যেমন ছিল, আবার দরকারও ছিল। আমার বাচ্চার ভেতরে ট্রমা কাজ করছে এখনও। দ্রুত সময়ের মধ্যে রেজাল্ট হয়েছে এটাই সন্তুষ্টি।’
তাশরিফা ফেরদৌস এবার সায়েন্স থেকে থেকে জিপিএ ৫ পেয়েছে। সে জানায়, ‘আন্দোলনের কারণে পড়াশোনায় একেবারেই মন বসছিল না। বাইরে আমাদের ভাইয়েরা মার খাচ্ছিল। আমাদের ভিকারুননিসার অনেকে আহত হয়েছে। এই অবস্থায় ঘরে বসে থাকা যায় না। এখনও ওইসব দিনের কথা মনে হলে খারাপ লাগে। তারপরও রেজাল্ট ভালো হয়েছে, এটাই বড় কথা।’
অপর শিক্ষার্থী তাসফিয়া তাহমিনা যুথির কথায়, ‘যেভাবে গুলি চলছিল, আমাদের ভাই-বোনেরা মারা যাচ্ছিল, বিষয়টা খুব দুঃখজনক ছিল। আমাদের কলেজের অনেকে আহত হয়েছিল। সেই পরিস্থিতি ভালো হয়েছে। রেজাল্টও ভালো এসেছে, এটা শান্তির। এখন ভর্তি পরীক্ষার অপেক্ষা। আমার টার্গেট বুয়েট।’
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাজেদা বেগম বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আমাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। আমাদের কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হয়। আন্দোলনে যেসব শিক্ষার্থী মারা গেছে তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। গত বছরের তুলনায় আমাদের ফল এবার আরও ভালো হয়েছে।’
দ্রুত রেজাল্ট হওয়ায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘সার্বিক দিক বিবেচনা করলে, সরকার যে একটা সুনির্দিষ্ট নীতিমালা অনুযায়ী রেজাল্ট দিয়েছে, এটা শিক্ষার্থীদের অনেক ট্রমা থেকে বাঁচিয়েছে।’