ধস আতঙ্কে জাবি শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা

আল বেরুনী হলদেয়ালের ভেতরে-বাইরে সারি সারি ফাটল। কোনও কোনও ফাটল ১০-১২ ফুট লম্বা। ফাটলের ওপরের অংশ থেকে সরে গেছে নিচের অংশ। কোথাও আবার দুই দেয়ালের ফাটল এসে মিশেছে এক বিন্দুতে। নিজের জায়গা থেকে সরে গেছে পিলারও। শঙ্কা, কখন যেন ধসে পড়ে!
এই চিত্র জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) আল-বেরুনী হলের সম্প্রসারিত ভবনের। গত ৪ জানুয়ারির ৬.৭ মাত্রার ভূমিকম্পে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এই আবাসিক হলটি। ওই ভূমিকম্পে ফাটল দেখা দেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মওলানা ভাসানী হলের উত্তর ব্লক (পদ্মা হাউস) ও শহীদ সালাম-বরকত হল ও আ ফ ম কামালউদ্দীন হলের যৌথ শিক্ষক কোয়ার্টারেও (ডি ৪১-৪৫)। তবে আল-বেরুনী হল সম্প্রসারিত ভবনের অবস্থা সবচেয়ে বেশি নাজুক।
ভূমিকম্পের দিন এসব ভবন পরিদর্শনের পর উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা ভেবে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস দেন। কিন্তু ঘটনার আড়াই মাস পার হলেও এখন পর্যন্ত কোনও উদ্যোগ নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ফলে জীবনের শঙ্কা নিয়েই দিন পার করছেন ভবন তিনটিতে বসবাসরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
প্রকৌশল কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ভবনগুলোর ফাটল অতিরিক্ত হওয়ায় সংস্কার কিংবা পরিত্যক্ত ঘোষণার বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল কার্যালয়ের আওতার বাইরে চলে যায়। প্রকৌশল কার্যালয় ভবন তিনটিকে অতিরিক্ত ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ উপদেষ্টা প্রকৌশল সংস্থা শহীদুল্লাহ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসকে দেখানোর পরামর্শ দেয়। সংস্থাটির পরিদর্শন ফি বাবদ প্রয়োজনীয় অর্থ চেয়ে ২০ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন কার্যালয়ে ফাইল পাঠায় প্রকৌশল কার্যালয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কার খাতে প্রয়োজনীয় অর্থ না থাকায় এই মুহূর্তে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না জানিয়ে ফাইল ফেরত পাঠায় পরিকল্পনা ও উন্নয়ন অফিস।

৪ জানুয়ারি ভোরের ৬.৭ মাত্রার ভূমিকম্পে আল-বেরুনী হল সম্প্রসারিত ভবনের বিভিন্ন অংশে অন্তত ৪০টি মারাত্মক ফাটল দেখা দেয়। এতে অল্পের জন্য বড় ধরণের প্রাণহানি থেকে রেহাই পান হলটিতে বসবাসরত প্রায় ২শ’ শিক্ষার্থী। তবে উচ্চমাত্রার ভূমিকম্পে বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে ১৯৮২ সালে নির্মিত এই হলটি।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, হলটির ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর (৮০০) ব্লকের উত্তর দিকের দেয়ালে প্রায় ২০ ফুট জায়গাজুড়ে ফাটল রয়েছে। খসে পড়েছে পলেস্তারাঁ। এছাড়া ব্লকটির শিক্ষার্থীদের থাকার অধিকাংশ কক্ষেও রয়েছে ভয়ংকর ফাটল।

হলের বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান স্মৃতি মিলনায়তনের টিভিরুমের পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকের দেয়ালের ভেতরে ও বাইরে কয়েক ফুট জায়গাজুড়ে বড়সড় ফাটল রয়েছে।

ল্যান্স নায়েক মুন্সী আব্দুর রউফ (১১০০) ও ইঞ্জিনিয়ার বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন (১০০০) ব্লকের বেশ কয়েকটি কক্ষের দেয়াল ও মেঝেতে ফাটল চোখে পড়েছে। বাদ যায়নি হলের মসজিদ, কমনরুম, গেস্টরুম, ডাইনিং রুম ও স্টাফরুমও। এসব কক্ষেও দেখা দিয়েছে বেশ বড় বড় ফাটল। এছাড়া হলের ৬টি ব্লকের অধিকাংশ কক্ষে চিড় ধরেছে।

হলটির আবাসিক শিক্ষার্থী সাজ্জাদ আহমেদ বলেন, শুনেছি দুর্বল অবকাঠামো ও দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার না করায় আগে থেকেই হলটির অবস্থা খারাপ ছিল। ভূমিকম্পে অবস্থা আরও বেগতিক হয়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এখানে বাস করছি।

মওলানা ভাসানী হলে গিয়ে দেখা যায়, ৪তলা হলটির নিচতলার উত্তর ব্লকের (পদ্মা হাউস) বাইরে অংশে অন্তত ৮টি জায়গায় ফাটল রয়েছে। ভূমিকম্পের পর প্রকৌশল কার্যালয়ের পরামর্শে ফাটল ধরা অংশগুলোতে সিমেন্টের প্রলেপ দেওয়া হয়েছে। ওই ব্লকের ২২টি কক্ষে প্রায় শ’ খানেক শিক্ষার্থী বাস করেন।

শহীদ সালাম-বরকত হল ও আ ফ ম কামালউদ্দীন হলের যৌথ শিক্ষক কোয়ার্টারে (ডি ৪১-৪৫) গিয়ে দেখা যায়, ৪তলা ভবনটির ভেতরে ও বাইরের বিভিন্ন জায়গায় ফাটল ধরেছে। খসে পড়েছে পলেস্তারা। যদিও আগে থেকেই ভবনটির অবস্থা নড়বড়ে ছিল।

বিভিন্ন বিভাগের ৭ জন শিক্ষক তাদের পরিবার নিয়ে এই ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে বসবাস করছেন। তাদের আশঙ্কার কথা জানালেন কয়েকজন শিক্ষকও।

নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. এ কে এম আবুল কালাম বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ঝুঁকিপূর্ণ পুরাতন ভবনগুলো আসলে কতটুকু ভূমিকম্প সহনশীল তা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল বিভাগের গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে দেখা উচিৎ। তা না হলে যে কোনও সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। আর নতুন ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে অবশ্যই ভূমিকম্পের বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া দরকার।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রকৌশলী আবদুস সালাম মো. শরীফ বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করে ২-৩ দিনের মধ্যেই পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার অধ্যাপক আবুল খায়ের বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা যে আর্থিক সংকটের মধ্যে ছিলাম তা কাটিয়ে উঠেছি। উপদেষ্টা সংস্থা শহীদুল্লাহ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। শিগগিরই ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত আসবে।’

/এজে/