প্রাথমিকে আরও একটি অধিদফতর হচ্ছে

প্রাথমিক শিক্ষার মান পরিবীক্ষণ, মূল্যায়ন ও প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহি নিশ্চিত করতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে আরও একটি নতুন অধিদফতর হচ্ছে। বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ইউনিটকে রূপান্তর করে হচ্ছে নতুন এই অধিদফতর। এর নাম প্রস্তাব করা হয়েছে ‘প্রাথমিক শিক্ষা পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন অধিদপ্তর’।

প্রস্তাবনায় বলা হয়, এই অধিদফতর প্রাথমিক শিক্ষার মান পরিবীক্ষণ, মূল্যায়ন ও গবেষণা এবং সুপারিশ প্রণয়ন করবে। শুধু পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নই নয়, ডাটাবেজ তৈরি ও সংরক্ষণ এবং প্রাথমিক শিক্ষা সংক্রান্ত তথ্য ও বক্তব্য প্রচার করবে এই অধিদফতর। পূর্ণাঙ্গ একটি কার্যকর অধিদফতর হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ায় প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়ন, প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত হবে। মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

‘প্রাথমিক শিক্ষা পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন অধিদপ্তর’-এর প্রস্তাবনা সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) ড. আবু শাহীন মো. আসাদুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এটির প্রস্তাব করা হয়েছে। একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী মন্ত্রণালয় চূড়ান্ত করবে।’

মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের গত ১৯ মার্চ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ইউনিটের দাফতরিক স্ট্যাটাস নির্ধারণের লক্ষ্যে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দারের উপস্থিতিতে এই সভায় সভাপতিত্ব করেন মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু তাহের মো. মাসুদ রানা।

সভায় জানানো হয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় অতিরিক্ত সচিবের (প্রশাসন) নেতৃত্বে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) এবং বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ইউনিটের প্রতিনিধিকে সদস্য করে একটি কমিটি গঠন করা হয়।

সভাসূত্রে জানা গেছে, কমিটির সদস্যরা সর্বসম্মতিক্রমে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ইউনিটের দাফতরিক স্ট্যাটাস ও কার্যক্রম নির্ধারণের বিষয়ে তিনটি বিকল্প প্রস্তাব বিবেচনার জন্য সুপারিশ করে।

প্রস্তাবগুলোর মধ্যে রয়েছে—বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ইউনিটকে বিদ্যমান কাঠামোতে রেখে জনবল সমন্বয়ের মাধ্যমে কার্যকর করা, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ইউনিটের বিদ্যমান জনবলকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নবসৃষ্ট পরিবীক্ষণ ও সমন্বয় অনুবিভাগের সঙ্গে একীভূত করা এবং বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ইউনিটকে স্বতন্ত্র এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি অধিদফতরে রূপান্তর করা।

নতুন অধিদফতরের প্রস্তাবের সুপারিশ

কমিটির সুপারিশে জানানো হয়, ইউনিটকে বিদ্যমান কাঠামোতে রেখে জনবল সমন্বয়ের মাধ্যমে কার্যকর করা এবং ইউনিটের বিদ্যমান জনবলকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নবসৃষ্ট পরিবীক্ষণ ও সমন্বয় অনুবিভাগের সঙ্গে একীভূত করার প্রস্তাব দুটি বাস্তবায়ন করা যুক্তিযুক্ত হবে না মর্মে অভিমত ব্যক্ত করা হয়।

আর তৃতীয় বিকল্পটি বাস্তবায়ন করা হলে প্রতিষ্ঠানটি অধিকতর কার্যকর হতে পারে মর্মে সদস্যরা মতামত প্রদান করেন।

বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ইউনিটকে স্বতন্ত্র এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি অধিদফতরে রূপান্তরের প্রস্তাবে বলা হয়, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ ইউনিটের নাম পরিবর্তন করে ‘প্রাথমিক শিক্ষা পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন অধিদপ্তর’ নামে নামকরণ করা হবে এবং ‘প্রাথমিক শিক্ষা পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন অধিদপ্তর’-এর কার্যপরিধি তুলে ধরা হয়। 

নতুন অধিদফতরের কার্যপরিধি

কার্যপরিধিতে প্রাথমিক শিক্ষার মান পরিবীক্ষণ, মূল্যায়ন ও গবেষণা এবং সুপারিশ প্রণয়নসহ ১৭ দফা প্রস্তাব করা হয়।

এসব সুপারিশের মধ্যে রয়েছে—অধিদফতর প্রাথমিক শিক্ষার মান পরিবীক্ষণ, মূল্যায়ন ও গবেষণা এবং সুপারিশ প্রণয়ন করবে। পরিদর্শনকারী ও বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের প্রাথমিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মানোন্নয়ন সংক্রান্ত বিভিন্ন সুপারিশ বাস্তবায়ন কার্যক্রম সমন্বয় ও ফলোআপ করবে। বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর নিবন্ধন কার্যক্রম মনিটরিং ও নিবন্ধনের শর্তাবলি প্রতিপালন নিশ্চিত করবে। নিবন্ধনকৃত বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো কর্তৃক পরিচালিত লার্নিং সেন্টার (এনজিও’র মাধ্যমে পরিচালিত সেন্টারসহ), শিশু কল্যাণ ট্রাস্টের মাধ্যমে পরিচালিত বিদ্যালয় এবং কমিউনিটি বিদ্যালয়গুলো পরিদর্শন ও তদারকি করবে।

অধিদফতর প্রাথমিক শিক্ষার জন্য শ্রেণিভিত্তিক অ্যাকাডেমিক স্ট্যান্ডার্ড, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার স্ট্যান্ডার্ড এবং প্রয়োজনে শিক্ষকদের দক্ষতার স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারণ করবে। নির্ধারিত স্ট্যান্ডার্ড অনুসারে মান অর্জনের বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা এবং নিজস্ব কর্মকর্তাদের মাধ্যমে সারা বছর মাঠপর্যায়ে পরিদর্শন বা অন্য কোনও পন্থায় নিয়মিত পরিবীক্ষণ করবে।

নতুন অধিদফতরের কার্যপরিধিতে বলা হয়, মাঠ পর্যায়ে পরিদর্শনের জন্য ছক/ফরম্যাট/প্রশ্নমালা প্রণয়ন করা এবং সময়ে সময়ে তা হালনাগাদ করবে। বিদ্যালয়/প্রতিষ্ঠান/দফতর পরিদর্শনের জন্য তথ্য সংগ্রহ করবে এবং কোন কোন প্রতিষ্ঠান কোন সময়ে কোন পদ্ধতিতে পরিদর্শন করা প্রয়োজন তা যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ করবে।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের ইন্টিগ্রেটেড প্রাইমারি এডুকেশন ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সেন্টার (IPEMIS) এবং এ মন্ত্রণালয় এবং মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন অন্যান্য দফতর/সংস্থার তথ্যভান্ডারে প্রবেশাধিকার থাকবে এই অধিদফতরের।

পরিদর্শন প্রতিবেদন প্রাপ্তির পর তা বিধিমোতাবেক যাচাই-বাছাই ও প্রক্রিয়াকরণ করা এবং পরিদর্শনের সুপারিশের আলোকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা, প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেওয়া এবং প্রয়োজনীয় পত্রযোগোযোগ ও সমন্বয় করবে নতুন এই অধিদফতর।

এছাড়া জরিপ ও শুমারি পরিচালনা বা অন্যান্য কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষা সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ, বিশ্লেষণ এবং প্রতিবেদন প্রণয়নসহ প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম মূল্যায়ন করবে। প্রাথমিক শিক্ষা বিষয়ক জাতীয় ডকুমেন্টেশন সেন্টার সৃজন ও পরিচালনা করা হবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইজ) আদলে।

অধিদফতরের কর্মপরিধিতে আরও বলা হয়, নতুন প্রাথমিক শিক্ষা সংক্রান্ত তথ্য ও বক্তব্য প্রচার করবে এই অধিদফতর। আর বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কিন্ডারগার্টেন ও হাইস্কুল সংলগ্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নিবন্ধন কার্যক্রম এবং নিবন্ধনের শর্তাবলি প্রতিপালনের কার্যক্রম পরিবীক্ষণ করবে।

বেসরকারি প্রাথমিকের নিবন্ধন

প্রস্তাবনায় বলা হয়, নতুন অধিদফতর বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কিন্ডার গার্টেন ও হাইস্কুল সংলগ্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নিবন্ধন কার্যক্রম এবং নিবন্ধনের শর্তাবলি প্রতিপালনের কাজও করবে নতুন এই অধিদফতর।

নতুন নিয়োগবিধির প্রস্তাবনা

নতুন অধিদফতর চূড়ান্ত হলে নতুন অধিদফতরের সাংগঠনিক কাঠামো এবং খসড়া নিয়োগবিধি প্রণয়ন করতে পারবে। তবে সে ক্ষেত্রে খসড়া নিয়োগবিধি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়সহ যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিতে হবে। নতুন অধিদফতর গঠনের পর দায়িত্বপ্রাপ্ত মহাপরিচালক দ্রুততম সময়ের মধ্যে সাংগঠনিক কাঠামো ও নিয়োগবিধির খসড়া প্রণয়ন করে মন্ত্রণালয়ে পাঠাবেন।

প্রসঙ্গত, দীর্ঘদিন ধরে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ইউনিটকে স্বতন্ত্র একটি অধিদফতর করার দাবি থাকলেও বিগত সময়ে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় তা হয়নি।

মন্ত্রণালয়ের অধীন অধিদফতর ও সংস্থা

বর্তমানে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো, জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা অ্যাকাডেমি, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ইউনিট এবং শিশু কল্যাণ ট্রাস্ট রয়েছে। 

পরিবীক্ষণ ইউনিটের বিদ্যমান অবস্থা

বর্তমানে এই বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ইউনিটের অফিস শিক্ষা ভবনে। অফিস প্রধানের এই ইউনিটে বর্তমানে কর্মরত রয়েছেন ৫৫ জন। এই ইউনিটের গুরুত্ব কম দেওয়ায় এই ইউনিটের চাকরিজীবীরা প্রায় ৩০ বছর ধরে পদোন্নতি বঞ্চিত রয়েছেন বলে জানান ইউনিটের একাধিক কর্মকর্তা।