১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর মারা যান নব্বই দশকের সফল নায়ক সালমান শাহ্। বাংলা সিনেমার তুমুল জনপ্রিয় এ নায়ক আত্মহত্যা করেছিলেন নাকি তাকে খুন করা হয়েছিল— এ প্রশ্ন থামেনি এখনও। মৃত্যুর পর বাবা কমরউদ্দিন আহম্মদ চৌধুরী একটি অপমৃত্যুর (ইউডি) মামলা দায়ের করেছিলেন।এরপর থানা-পুলিশ, গোয়েন্দা পুলিশ, সিআইডি, র্যাব একে একে মামলাটির তদন্ত করে। মাঝখানে ১৫ বছর ধরে চলেছে বিচার বিভাগীয় তদন্তও। সব কটি তদন্ত প্রতিবেদনেই এটিকে আত্মহত্যা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সর্বশেষ তদন্তভার দেওয়া হয়েছে পুলিশের নবগঠিত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই)।
এদিকে সম্প্রতি এ মামলার অন্যতম আসামি আমেরিকা প্রবাসী বাবেয়া সুলতানা রুবি একটি ভিডিও বার্তা প্রকাশ করেন ফেসবুকে। সেখানে তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন আত্মহত্যা নয়, খুন হয়েছিলেন সালমান শাহ্। আসামি হয়েও রুবির এমন চাঞ্চল্যকর বার্তায় শুরু হয়েছে তোলপাড়। টানা একুশ বছর পর কেন এমন বার্তা দিলেন রুবি? এর কতটাইবা সত্যি- প্রশ্ন উঠছে এসব নিয়েও। জবাব খুঁজতে মঙ্গলবার (৮ আগস্ট) দুপুরে রুবির সঙ্গে সরাসরি মুঠোফোনে কথা হলো বাংলা ট্রিবিউনের। তারই উল্লেখযোগ্য অংশ তুলে ধরা হলো।
রুবি: হ্যাঁ, আমি রাবেয়া সুলতানা রুবি বলছি। আমাদের এখানে তো এখন ফজরের ওয়াক্ত, নামাজ পড়ে নিই?
বাংলা ট্রিবিউন: বেশি সময় লাগবে না। সম্ভব হবে কথা বলা?
রাবেয়া সুলতানা রুবি: হ্যাঁ। বলুন।
বাংলা ট্রিবিউন: সালমান শাহ-এর চাঞ্চল্যকর মৃত্যু প্রসঙ্গে আপনার একটি ভিডিও বার্তা নিয়ে বেশ আলোচনা সমালোচনা চলছে। সেখানে জানিয়েছেন আপনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ প্রশাসনের কোনও সহযোগিতা চেয়েছেন বা পেয়েছেন? বর্তমান অবস্থা কী?
রাবেয়া সুলতানা রুবি: আমি তো সহযোগিতা চাইনি এখনও। তবে চাইলে পাবো বলে মনে হয়।
বাংলা ট্রিবিউন: ঢাকা থেকে কেউ যোগাযোগ করেছেন?
রাবেয়া সুলতানা রুবি: একজন করেছেন। উনার নাম সিরাজ। সিরাজ সাহেব।
বাংলা ট্রিবিউন: তিনি কি বাংলাদেশের প্রসাশনের সঙ্গে যুক্ত?
রাবেয়া সুলতানা রুবি: না, আমি তা নিশ্চিত নই। আমি অত কিছু জানতেও চাইনি। তবে আমার মনে হয়েছে তিনি আমাকে ভেরিভাই করছিলেন। আমার কোনও সন্দেহ নাই যে, তিনি পুলিশের লোক। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করছিলেন, আমি ঢাকায় আসব কিনা? মানে বাংলাদেশে যাব কিনা? আমি বলেছি, না, আমি যাব না। আপনারা আসেন না কেন!
রুবির সঙ্গে কথোপকথন:
বাংলা ট্রিবিউন: আপনি ভিডিওতে বলছিলেন আদালতে সাক্ষী দিতে চান। এরজন্য হলেও তো আপনার দেশে ফেরা উচিত?
রাবেয়া সুলতানা রুবি: সাক্ষী তো আমি না ভাই। সাক্ষী তো আমার ছেলে। আমার বড় ছেলে (ভিকি)। আমি তো অল্পকিছুর সাক্ষী। কিন্তু আমার ছেলে হলো সেদিনের সালমান শাহ্ ঘটনার বড় সাক্ষী। যে সামিরার দেওয়া জিনিস এক ছাদ থেকে অন্য ছাদে পার করেছে। ওদের বাসা থেকে আমাদের বাসার ছাদে একটা কাপড়ের পুঁটলি পাচার করেছে আমার ছেলেকে দিয়ে, যেদিন ইমন (সালমান শাহ) মারা যায়। সামিরার কাপড়ের পুঁটলিটি আমার ছেলের হাতে দিয়েছিল পার করতে। তখন আমার ছেলের বয়স ১৭ বছর।
তখন তো আমার সন্দেহ হবেই। কারণ যার স্বামী মারা যায়, আত্মহত্যা করে সে কেন একটা বাচ্চা ছেলেকে দিয়ে কাপড়ের পুঁটলি পাচার করবে? এর মানেটা কী?
বাংলা ট্রিবিউন: ছাদের উপর থেকে তো অনেক ডিসটেন্স ছিলো। আমি যতটুকু জানি আপনাদের ভবন আর সালমান শাহের ভবনের মাঝে রাস্তা ছিল। এটা কীভাবে সম্ভব?
রাবেয়া সুলতানা রুবি: না, না ছুঁড়ে দিলে ডিসটেন্স বেশি না। আপনি যদি ইস্কাটন প্লাজায় যান বিষয়টি বুঝতে পারবেন।
বাংলা ট্রিবিউন: পুঁটলিতে কী ছিল?
রাবেয়া সুলতানা রুবি: সেটা সে (ভিকি) জানে না। আমার ছেলে আমাকে বলেছে, মা আমার হাতে সামিরা দিয়েছে। বলেছে যে, তোমাদের ছাদে পাঠিয়ে দাও। আমি ছুঁড়ে দিয়েছি। নিচ থেকে সবাই দেখছিল। আর ‘হু হু’ করে চিৎকার করছিল। তখন আমি ছেলেকে বললাম, তাহলে এ জন্যই নীলা ভাবি কেসের মধ্যে আমার নাম ঢুকিয়েছে!
বাংলা ট্রিবিউন: এটা কখন সে (ছেলে) আপনাকে জানায়?
রাবেয়া সুলতানা রুবি: আমার ছেলে কানাডাতে থাকে। গত মাসে আমি সেখানে বেড়াতে গিয়েছিলাম। তখন সে আমাকে জানায়। আর এর পরই আমি ভিডিওটি লাইভ করি। কথা হলো, সামিরা আমার ছেলেকে কী জিনিস দিয়েছিল, এটা সামিরা বলতে পারবে। আর কেউ নয়।
বাংলা ট্রিবিউন: জিনিসটার পরিণতি আসলে কী হলো? পুঁটলিটা কে নিল?
রাবেয়া সুলতানা রুবি: আমার ছেলে তো আর কেয়ার করেনি। এক ছাদ থেকে আরেক ছাদে সে ফেলে দিয়েছে। সেই ভালোভাবে বলতে পারবে আর কী ঘটেছিল। আমার হাজবেন্ড ও ভাইয়ের ব্যাপার পরে আসবে। আগে আসা উচিত সামিরা আমার ছেলের হাতে কী জিনিস দিয়েছে- তা।
বাংলা ট্রিবিউন: কিন্তু আপনাকে যদি দেশে আসতে হয়, আসবেন?
রাবেয়া সুলতানা রুবি: সাক্ষীর বিষয় হলে, অবশ্যই দেশে আসব। আসব না কেন? আগে তো বাড়িতে যাই।
বাংলা ট্রিবিউন: আপনি এখন কোথায়?
রাবেয়া সুলতানা রুবি: আমি এখন নিউ ইয়র্কে। আমার বাড়ি পেনসিলভানিয়ায়। বাড়িতে গিয়ে আমি আমার হাজব্যান্ডের সঙ্গে মোকাবেলা করব। ও তো জানে না, আমি এ কাজটি (ভিডিও বার্তা) করেছি। এখন হয়তো জানে।
বাংলা ট্রিবিউন: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন উঠছে তা হলো- সালমান শাহ প্রয়াত হওয়ার ২১ বছর পর আপনি স্বীকারোক্তি ধরনের ভিডিও প্রকাশ করলেন। এত দিন কেন এটা করেননি? আর আগেও আপনি বহু ভিডিও প্রকাশ করেছেন। সেখানে আত্মপক্ষ সমর্থন করেছেন। বলেছেন সালমান আত্মহত্যাই করেছেন। এত মতদ্বৈততা কেন?
রাবেয়া সুলতানা রুবি: আমি তো ভিডিও প্রকাশ করিনি। ভিডিও তো লাইভ নেওয়া হয়েছে। কারণ আমার ছেলে ভিকির কাছ থেকে আমি মাত্রই জেনেছি। গত মাসে। যখন আমি কানাডাতে আমার ছেলের কাছে বেড়াতে যাই। গত মাসের ১৪ তারিখ। আমার কাছে টিকিট-মিকিট সবই আছে। ছেলে আমাকে টিকিট কেটে ফেরত পাঠিয়েছে। বলেছে, মা তুমি বাসায় যাও বা নিউ ইয়র্কে থাকো।
কানাডা থেকে বাসায় গিয়ে অনেক চিন্তা-ভাবনা করে, শুক্রবার (৪ আগস্ট) চলে এলাম নিউ ইয়র্কে। কারণ কনসাল জেনারেলের অফিসে যাব। তারপর আমি বিষয়টি রিপোর্ট করব। তাদের অফিসে গতকাল (৭ আগস্ট) গেলাম। জেনারেল সাহেবকে পেলাম না। এক ঘণ্টা অপেক্ষা করে চলে এলাম। আবার বিকালে সাড়ে তিনটায় গেলাম, শুনি যে তিনি বের হয়ে গেছেন।
ওখানে হাসান নামের একজন কর্মকর্তা আছেন। তাকে বললাম, কীভাবে রিপোর্ট করব, কার কাছে করব? পিবিআই আমাকে খুঁজবে। পিবিআইকে কীভাবে জানাব? তিনি বললেন, জানানোর দায়িত্ব তো আমাদের না। পিবিআই চিঠি লিখবে, তারপর আমরা জানাব।
আমি ভাবলাম, কোনও কাজ হবে না। এমনিতেই তো বাংলাদেশের আইনের প্রতি আমার শ্রদ্ধা কম। আমাকে মাফ করবেন, এভাবে বলাতে। দেশে তো ১৪ বছরেও যাইনি এই জন্য।
রুবির ভিডিও বার্তা:
বাংলা ট্রিবিউন: আপনার ভিডিও সত্যতা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন।
রাবেয়া সুলতানা রুবি: ভিডিওতে যা বলেছি, তার প্রমাণ হবে তদন্তের পর। সামিরাকে রিমাণ্ডে নিলেই হবে।
বাংলা ট্রিবিউন: আরও একটি বিষয় আলোচনায় উঠে এসেছে, আপনাদের দাম্পত্য কলহের জেরে আপনি এখন এ কাজটি করেছেন- এমন ক্ষেত্রে কী বলবেন? এছাড়াও বারবার এতে আপনি অভিযুক্ত করেছেন আপনার চাইনিজ স্বামীকে।
রাবেয়া সুলতানা রুবি: দাম্পত্য কলহ কেন হবে না বলেন তো? যখন আমি জানি সব কিছু। আমি কি স্বামীর সঙ্গে অভিনয় করে যাব নাকি! এটা তো হবেই। যখন আমি জানব, আমার স্বামী কোনও কিছুর (হত্যাকাণ্ড) সঙ্গে জড়িত। আমার ছেলেও তো জড়িয়েই পড়েছিল। তার বয়স তখন ১৭। গার্লফ্রেন্ডও ছিল। নইলে অনেক কিছুই ঘটতে পারত!
বাংলা ট্রিবিউন: আপনার ছেলে আগে কেন বলেননি আপনাকে?
রাবেয়া সুলতানা রুবি: আমাকে বলতে চেয়েছিল কিন্তু আমি শুনিনি। বাঙালি হুজুগে চলে। কেন আমি আগে বলিনি, দাম্পত্য কলহ- সব বলছে এখন। কিন্তু এখন আমি বলবই। সামিরার বাবা যদি বলে… আচ্ছা, সামিরার বাবা কীভাবে এত কিছু জানে আমার সম্পর্কে? উনার সঙ্গে এত বছরেও যোগাযোগ নাই। উনাকে ৯৭ সালে শেষ দেখেছি। তিনি এসে আমাকে ডিবি অফিসে নিয়ে গেলেন। আমার তখনই বোঝা উচিত ছিল।
৩২ বছর আমি তার (জ্যানলিন) সঙ্গে সংসার করছি। দাম্পত্য কলহ হলে তো আমি তাকে ডিভোর্স করতাম। ওরে ডিভোর্স করলে আমি ওর বাড়ি পেয়ে যেতাম। কারণ সাড়ে ১৫ বছর আমরা এই বাড়িতেই আছি।
বাংলা ট্রিবিউন: আপনি ভিডিওতে বলেছেন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এখন আপনি বাড়িতে ফিরে যাচ্ছেন। আপনার জীবন সংশয়ে। কোনও ব্যবস্থা কি নিয়েছেন?
রাবেয়া সুলতানা রুবি: আমি নিরাপত্তাহীনতা ফিল করেছি। কেউ থ্রেট দেয়নি। শোনেন ভাই, সাড়ে ১৫ বছর আমেরিকায় আছি। এমনি তো ডাল-ভাত খাই। আইন সম্পর্কে আমার যথেষ্ট ধারণা আছে। আমি সেভাবেই এগুবো।
* আসামির ভিডিও বার্তা: সালমান শাহ্ খুন হয়েছেন