চলে গেলেন কিংবদন্তি শিল্পী আবদুল জব্বার





আবদুল জব্বার

চিরকালের জন্য স্তব্ধ হলো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কিংবদন্তি শিল্পী আবদুল জব্বারের দরাজ কণ্ঠ। তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে। বুধবার (৩০ আগস্ট) সকাল ৯টা ১০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন গুণী এই শিল্পী (ইন্নালিল্লাহি...রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর।

আবদুল জব্বারের মৃত্যুতে দেশীয় সংগীতাঙ্গনে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী তার শোক বার্তায় বলেন, ‘একুশে পদক ও স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত বিশিষ্ট এই শিল্পীর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে গাওয়া গান ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা ও মনোবল বাড়িয়েছিল।’

বুধবার বিএসএমএমইউ প্রাঙ্গণে আবদুল জব্বারের পরিবারের সদস্যরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী মরহুমের আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন এবং তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানান। 

বিএসএমএমইউ হাসপাতালে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর (ছবি: সাজ্জাদ হোসেন)আবদুল জব্বারের মৃত্যুর খবর পেয়ে বিএসএমএমইউ হাসপাতালে আসেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ও সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। এছাড়া শিল্পীর শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছেন সংগীতশিল্পীরা। 

বিএসএমএমইউ হাসপাতালে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু (ছবি: সংগৃহীত)১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন আবদুল জব্বার। হারমোনিয়াম কাঁধে কলকাতায় বাংলাদেশি শিবির ও মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পগুলোতে গান শুনিয়ে উদ্বুদ্ধ করেছেন মানুষকে। তাঁর গানে অনুপ্রাণিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন অনেকেই। এছাড়া প্রখ্যাত ভারতীয় কণ্ঠশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে মুম্বাইয়ের বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরিতে কাজ করেন তিনি।

মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বৃদ্ধিতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আবদুল জব্বার গেয়েছেন ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’, ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’সহ অংসখ্য গান। পথে পথে গণসংগীত গেয়ে পাওয়া ১২ লাখ টাকা তিনি দান করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের ত্রাণ তহবিলে।
দীর্ঘদিন ধরে কিডনি, হৃৎপিন্ড, প্রস্টেটসহ বিভিন্ন জটিলতায় ভুগেছেন আবদুল জব্বার। এ কারণে গত ৩১ মে থেকে বিএসএমএমইউ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন। গঠন করা হয়েছিল চিকিৎসা সহায়তা কমিটি। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে সবার চেষ্টা।

কান্নায় ভেঙে পড়েছেন আবদুল জব্বারের পরিবার (ছবি: সাজ্জাদ হোসেন)বিএসএমএমইউর কেবিন ব্লকের ৬২০ নম্বর কক্ষে নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) ডা. দেবব্রত বণিকের তত্ত্বাবধানে ছিলেন আবদুল জব্বার। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে সংকটাপন্ন অবস্থা ছিল তার। রক্তচাপ দ্রুত নেমে যাওয়ায় মৃত্যুর কাছে হার মানতে হলো যোদ্ধা মানসিকতার এই মানুষটিকে।

১৯৩৮ সালে ৭ নভেম্বর কুষ্টিয়ায় জন্মেছিলেন আবদুল জব্বার। ১৯৫৮ সাল থেকে তৎকালীন পাকিস্তান বেতারে গান গাইতে শুরু করেন তিনি। ১৯৬২ সালে চলচ্চিত্রে প্রথম গান গাওয়ার সুযোগ আসে তার কাছে। ১৯৬৪ সালে জহির রায়হান পরিচালিত পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম রঙিন ছবি ‘সংগম’-এর গানে কণ্ঠ দেন। একই বছর থেকে তৎকালীন পাকিস্তান টেলিভিশনে নিয়মিত গাইতেন তিনি।

সংগীত জীবনে ছয় হাজারেরও বেশি গান গেয়েছেন আবদুল জব্বার। এর মধ্যে কালজয়ী হয়ে আছে ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’, ‘ওরে নীল দরিয়া’, ‘তুমি কি দেখেছো কভু জীবনের পরাজয়’, ‘এক বুক জ্বালা নিয়ে বন্ধু তুমি’, ‘পীচঢালা এই পথটারে ভালোবেসেছি’, ‘বন্ধু তুমি শত্রু তুমি’ প্রভৃতি। বঙ্গবন্ধু স্বর্ণপদক (১৯৭৩), একুশে পদক (১৯৮০) ও স্বাধীনতা পদকসহ (১৯৯৬) অনেক সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন তিনি।

ব্যক্তিজীবনে তিনবার বিয়ে করেন আবদুল জব্বার। তার প্রথম স্ত্রী হালিমা জব্বার একজন মুক্তিযোদ্ধা। তাদের দুই ছেলে মিথুন জব্বার ও বাবু জব্বার এবং মেয়ে মুনমুন জব্বার। দ্বিতীয় স্ত্রী শাহীন জব্বার ছিলেন গীতিকার। তার তৃতীয় স্ত্রী ডলি জব্বার বাংলাদেশ বেতারের একজন কর্মকর্তা।