একান্ত আলাপে যশপাল শর্মা: ঢাকা শিল্পী আর শিল্পের নগরী

২৬ মার্চ শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে যশপালটানা ১৭ দিন বাংলাদেশে শুটিংয়ের পর আজ সকালে (২৭ মার্চ) মুম্বাইগামী বিমানের সিঁড়িতে পা রাখার সব প্রস্তুতি শেষ করেছেন বলিউড অভিনেতা যশপাল শর্মা। তার কয়েক ঘণ্টা আগে, এই রাতে (২৬ মার্চ) বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে আড্ডায় বসলেন।

পুরোটা সময়ই তার মুখে বাংলাদেশের স্তুতি! শিল্পকলা, শহীদ মিনার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং খুলনার পাইকগাছা নিয়ে কত কত কথা! ভারতীয় এ অভিনেতা তৌকীর আহমেদের ‘ফাগুনের হাওয়ায়’ ছবিতে কাজ করেছেন পাকিস্তানি অফিসারের চরিত্রে। তাই এদেশের জন্ম নিয়েও তার আগ্রহ অপরিসীম। জানালেন, পরিচালক তৌকীর আহমেদ, সহশিল্পী আবুল হায়াত, তিশা, সায়েমদেরও কথা। বিস্তারিত শোনা যাক তার কাছ থেকেই :
বাংলা ট্রিবিউন: আপনি কিন্তু এর আগেও বাংলাদেশের জন্য ছবি করেছেন!
যশপাল শর্মা: না, এটাই প্রথম।
বাংলা ট্রিবিউন: না, এটা প্রথম নয়। এর আগে ‘মুক্তি’ নামের একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবিতে আপনাকে দেখেছিলাম। সেটা ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর নির্মিত। সেই সূত্রে কিন্তু বাংলাদেশের জন্য এটি আপনার দ্বিতীয় কাজ!
যশপাল শর্মা: তা বটে, তা বটে। তবে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র হিসেবে এটি (ফাগুন হাওয়ায়) আমার প্রথম কাজ। ‘মুক্তি’ ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা জ্যাকব ও পাকিস্তানের জেনারেল নিয়াজির কথোপকথন নিয়ে ছবি। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিনে নিয়াজির আত্মসমর্পণের ঘটনা নিয়ে নির্মিত।
শুটিংয়ের একটি দৃশ্যে তিশা-সিয়ামের সামনে যশপাল (ডানে)বাংলা ট্রিবিউন: আপনি এদেশ সম্পর্কে নিশ্চয়ই কিছুটা জানতেন, ঢাকায় নেমে কতটা পার্থক্য পেলেন!
যশপাল শর্মা: না। ঢাকা সম্পর্কে তেমন আইডিয়া আমার ছিল না। তবে খুলনার পাইকগাছা থেকে টানা শুটিং থেকে ফিরে আজ (২৬ মার্চ) যখন চোখ মেলে ঢাকা শহরটাকে দেখার সুযোগ পেলাম, তখন মনে হলো এটি আসলে শিল্পী আর শিল্পের নগরী!
ভাস্কর্য দেখছি, নাটক চলছে, গান হচ্ছে, পেইন্টিং চলছে। অসাধারণ! ঢাকা একটি শিল্পময় নগরী। আমি অভিভূত! আমি খুব ভাগ্যবান যে এমন একটি দেশে কাজ করতে এসেছি।
বাংলা ট্রিবিউন: শুনলাম আজ (২৬ মার্চ ) ঢাকা শহর চষে বেড়িয়েছেন! কোথায় কোথায় গিয়েছিলেন?
যশপাল শর্মা: এ ক’দিনের কাজের মধ্যে আমি আজই ফ্রি হয়েছি। তাই ঢাকায় এসে রাস্তায় নামতে আর দেরি করিনি।
প্রথমে আমি শিল্পকলা একাডেমি গিয়েছিলাম। সেখানে ভাস্কর্য দেখেছি, ‘সোনাই মাধব’ মঞ্চায়নের আগে তাদের গ্রিনরুমে গিয়েছিলাম। এর গল্পটা যেমন চমৎকার, পোশাকও অসাধারণ। চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদের প্রদর্শনী দেখলাম। আমার জীবনের স্মরণীয় প্রদর্শনীর একটি। এত ভালো লেগেছে যে আমি সব ছবি তুলেছি। এরমধ্যে শহীদ মিনারেও গেলাম। অনেক তথ্য জানলাম। বুকটা জুড়িয়ে গেল।

সাচ্চু (শহীদুল আলম সাচ্চু) ভাই সঙ্গে না থাকলে আমি বাংলাদেশটাকে এভাবে দেখতে পারতাম না। অসম্ভব বিনয়ী এ মানুষটাকে ধন্যবাদ।
বাংলা ট্রিবিউন: ‘ফাগুন হাওয়ায়’-এর অভিজ্ঞতা কেমন?
যশপাল শর্মা: ভাষা আন্দোলনের ছবি। খুব সরলভাবে পরিচালক গভীর কিছু বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। এখানে আমি পাক আর্মির চরিত্রে অভিনয় করেছি। যে চায় বাংলা থেকে উর্দু হোক ভাষা। কিন্তু সে তা করতে পারেনি।
যশপাল, শহীদ মিনারেবাংলা ট্রিবিউন: এই চলচ্চিত্রে যুক্ত হওয়ার গল্পটি শুনতে চাই!
যশপাল শর্মা: তৌকীর আহমেদ, অসাধারণ পরিচালক। তিনিই প্রথম আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আমি তার দুটি ছবি ‘হালদা’ ও ‘অজ্ঞাতনামা’ দেখি। ভালো লাগে। অসাধারণ ছবি। তবে যখন তিনি ‘ফাগুনের হাওয়ায়’ ছবির পাণ্ডুলিপি পাঠালেন, আরও মুগ্ধ হয়েছি। তৌকীর যেভাবে বলেছেন, আমি তার সব কথা মেনে নিয়েছি। আমি বলে রাখছি, এই ছবিটা অস্কারে যাবে। কাজ করতে গিয়ে এই বিশ্বাসটা জন্মেছে।
বাংলা ট্রিবিউন: আর কো-আর্টিস্ট? তারা কেমন সাপোর্ট দিলেন!
যশপাল শর্মা: খুলনার পাইকগাছায় আমরা পুরো টিম অসাধারণ কয়েকটি দিন কাটিয়েছি। সায়েম ও তিশা অসাধারণ আর্টিস্ট! ‘তিশা কা কোয়ি জবাবই নেহি হে’ (এ পর্যায়ে ইংরেজি ছেড়ে খাস হিন্দিতে প্রশংসা শুরু করলেন)। আর একজন অভিনেতা ছিলেন আবুল হায়াত- অসাধারণ।
এছাড়া মোশাররফ করিম, সাজু খাদেম, হাসান আহমেদ, সাবরিনাসহ আরও অনেকেই ছিলেন। প্রত্যেকে খুবই ভালো শিল্পী। টিমটাই অসাধারণ। আমি খুব ট্যালেন্টেড কিছু মানুষের সঙ্গে কাজ করলাম।
বাংলা ট্রিবিউন: আর নির্মাতা?
যশপাল শর্মা: তৌকীরের কথা না বললেই নয়। তিনি খুব পরিষ্কার, তার কাজের বিষয়ে। লো বাজেটের ছবিতে বাংলাদেশে তিনিই সেরা।

বাংলা ট্রিবিউন: অভিনেতা বলতে আমরা যা বুঝি আপনি তাই। নায়ক নন, জাঁদরেল অভিনেতা। আপনার বলিউড যাত্রাও তো মন্দ নয়।
যশপাল শর্মা: বলিউডে আমি অনেক বছর ধরে সংগ্রাম করেছি। এখনও তো করি।
৮৪ সালে আমি থিয়েটারে যুক্ত হই। আমি হরিয়ানার বাসিন্দা। সেখানে কাজ করেছি। চন্ডীগড় থেকে ড্রামাতে এমএ করি। আর দুই বছর দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামাতে লেখাপড়া করি।
৯৭-এ আমি বোম্বেতে যুক্ত হই ‌‘হাজার চুরাশি কি মা’ ছবির মাধ্যমে। তবে ২০০১-এ এসে আমি ভালো ক্যারেকটার পাই। সেটা হলো ‘লগান’ ছবিতে। বলিউডে আমার বাপ, মা, ভাই কেউ নেই। ফলে আমাকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। এরপর বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ছবিতে সুযোগ পেয়েছি। যেগুলো হয়তো আপনার দেখেছেন। ‘পুকার’, ‘গঙ্গাজল’, ‘রাউডি রাঠোর’, ‘অপহরণ’, ‘সিং ইজ কিং’, ‘সরকার’, ‘গ্যাংস অব ওয়াসিপুর’- অনেক ছবি!
এগুলো কমার্শিয়াল ছবি। তবে আমার অভিনীত বেশিরভাগ ছবিই হলো আর্ট ফিল্ম ও কম বাজেটের। যেগুলো বিশ্বব্যাপী উৎসবে প্রদর্শিত হচ্ছে।
যশপাল শর্মা (ফাইল ছবি), শুটিংয়ের ফাঁকে চেয়ারে বসে শট বুঝে নিচ্ছেন
বাংলা ট্রিবিউন: আপনি কি এখনও মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত?
যশপাল শর্মা: হ্যাঁ, আমি এখনও কাজ করে যাচ্ছি। এই যে আজ শিল্পকলায় একটি মঞ্চনাটকের গ্রিনরুমে গিয়েছিলাম, সেখান থেকেও আইডিয়া নিলাম। এটি আমার হরিয়ানার মঞ্চে কাজে লাগাব। আমি এখনও মঞ্চের ১১টি নাটকে অভিনয় করে যাচ্ছি। আসলে এটা আমাকে মনের খোরাক দেয়। আর কমার্শিয়াল ছবিতে কাজ করি টাকার জন্য। জীবনটা তো চালাতে হবে!
বাংলা ট্রিবিউন: বলিউডের পরবর্তী কাজের খবর কী!
যশপাল শর্মা: এ বছর আমার আরও তিনটি ছবি আসার কথা। ‘চোহান: কমনম্যান’, ‘মিস্টার পানওয়ালা’ আর আমি একটি ছবি পরিচালনা করতে যাচ্ছি। এটি গ্রাম্য মানুষকে নিয়ে। এর প্রি-প্রোডাকশনের কাজ চলছে। আশা করি সেপ্টম্বরে এটির শুট করতে পারব।
বাংলা ট্রিবিউন: সকালেই (২৭ মার্চ ) তো মুম্বাই উড়াল দিচ্ছেন। আবার কবে আসছেন!
যশপাল শর্মা: আমি আবার আসতে চাই। ‘ফাগুন হাওয়ায়’ ছবির প্রমোশনে অংশ নিতে চাই। তৌকীর যেদিন ডাকবেন আমি চলে আসব। কোনও সমস্যা নেই। এলে আমি বরং খুশিই হবো।

প্রসঙ্গত, যশপাল শর্মাকে নিয়ে খুলনার পাইকগাছায় গত ১০ মার্চ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত ‘ফাগুন হাওয়ায়’ ছবির টানা শুটিং হয়েছে।