সেলফি নিষিদ্ধ করেছেন যিনি, তার সঙ্গেই সেলফি!

সংবাদ সম্মেলনে থিয়েরি ফ্রেমোজরুরি ই-মেইল। বিষয় ‘রকোত এভেক লা প্রেস’। এর ইংরেজি করলে দাঁড়ায় ‘মিটিং উইথ দ্য প্রেস’। আয়োজকরা জানিয়েছেন, কান উৎসবের পরিচালক থিয়েরি ফ্রেমো সাংবাদিকদের সঙ্গে বসবেন। আগের তিনবার এমন কোনও ই-মেইল আসেনি, তিনিও উৎসব শুরুর আগে আমাদের সঙ্গে বসেননি। কিন্তু এবার বিভিন্ন বিতর্কিত কারণে তাকে আসতে হলো সাংবাদিকদের সামনে।
পালে দো ফেস্টিভ্যাল ভবনের তৃতীয়তলায় সংবাদ সম্মেলন কক্ষে সময়মতো এলেন থিয়েরি ফ্রেমো। এই লোকটাই কানের কলকাঠি নাড়েন। তিনিই সেলফি নিষিদ্ধ করেছেন, নেটফ্লিক্সকে প্রতিযোগিতা বিভাগে জায়গা দেননি, প্রেস স্ক্রিনিংয়ের সময়সূচিও বদলে দিয়েছেন। এসবের সঙ্গে মিটু হ্যাশট্যাগ আন্দোলন, যৌন কেলেঙ্কারির অভিযোগে নিন্দিত হার্ভি ওয়াইনস্টিন কাণ্ড, প্রতিযোগিতা বিভাগের মূল বিচারক হিসেবে নারীকে (কেট ব্ল্যানচেট) বেছে নেওয়া, নিষিদ্ধ পরিচালককে (লার্স ভন ট্রিয়ার) কানে ফিরিয়ে আনা; এমন আরও কিছু বিষয় নিয়ে কথা বললেন, সাংবাদিকদের প্রশ্ন ঘুরেফিরে এসবই এলো।
প্রশ্নকর্তাদের সমন্বয়কের দিকে হাত তুলে প্রশ্ন করার ইচ্ছে জানালাম। কিছুক্ষণের মধ্যে হাতে এলো মাইক্রোফোন। থিয়েরি ফ্রেমোর কাছে আমি বাংলা ট্রিবিউন-এর পক্ষ থেকে প্রশ্ন রাখলাম ইরানি নির্মাতা জাফর পানাহিকে নিয়ে। এবারের আসরে প্রতিযোগিতা বিভাগে তার পরিচালিত ‘থ্রি ফেসেস’ রয়েছে। কিন্তু তিনি নিজ দেশে গৃহবন্দি। বিদেশ ভ্রমণে তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছে ইরান সরকার। সেক্ষেত্রে উৎসবে তার অংশগ্রহণের সুযোগ নেই বললেই চলে।
সংবাদ সম্মেলন শেষে থিয়েরি ফ্রেমো ও জনি হকের সেলফি!ফ্রেমোর কাছে জানতে চাইলাম, এবারের উৎসবে জাফর পানাহির অংশগ্রহণের কোনও সুযোগ কি আছে? তার উত্তর, ‘জাফর পানাহি যেন কানে এসে নিজের ছবির প্রচারণা করতে পারেন সেই ব্যাপারে ইরান সরকারকে একটি চিঠি দিয়েছি আমরা। উৎসব শেষে তাকে আবার ইরানে ফিরিয়ে দেওয়ার আশ্বাসও উল্লেখ করেছি তাতে। ফ্রান্স সরকারের সংস্কৃতি ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ নিয়ে আলোচনা অব্যাহত রেখেছেন। আমরা আশা ছাড়িনি। দেখা যাক কী হয়।’
আয়োজকরা আশা ছাড়েননি সমাপনী ছবি টেরি গিলিয়ামের ‘দ্য ম্যান হু কিল্ড ডন কিহোটে’ নিয়েও। ফ্রেমো জানালেন, বুধবার (৯ মে) পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে তাদেরকে। আদালত ওইদিন রায় দেবেন। ছবিটির প্রযোজক পাওলো ব্রাঙ্কোর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তৈরি হয়েছে এই অনিশ্চয়তা। অনুমতি ছাড়াই নিজের ছবি কানে দেখানো হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন তিনি।
শিল্পীদের ব্যাপারে বরাবরই কান আন্তরিক। সংবাদ সম্মেলনে জোর দিয়ে একথা বললেন ফ্রেমো। লার্স ভন ট্রিয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কানে তাকে ফিরিয়ে আনা দরকার ছিল। তিনি রসিকতা করে নিজেকে নাৎসি বলেছিলেন। কিন্তু তিনি তা নন। তার এটা উচিত হয়নি। এ কারণে আমরা তাকে সাজা দিয়েছি। আমাদের পরিচালনা পর্ষদ মনে করছে, যথেষ্ট হয়েছে। এবার একজন শিল্পী হিসেবে তাকে ফেরানো যায়। সারা বিশ্বের চলচ্চিত্র নির্মাতাদের কাছে যেন মনে হয় কান তাদের বাড়ি। কান শুধু আয়োজকদের নয়, কান আমাদের সবার। এই উৎসব শিল্পীদের সুরক্ষা করে।’
সংবাদ সম্মেলনের অনেকটা অংশজুড়ে ছিল হার্ভি ওয়াইনস্টিন প্রসঙ্গ। কানেও তিনি যৌন হয়রানির মতো কাণ্ড ঘটিয়েছেন বলে আয়োজকরা এবার যৌন হয়রানি প্রতিরোধে হটলাইন চালু করছে। ফ্রেমো বললেন, ‘আমাদের একটি টিম এই ফোন লাইনের পেছনে থাকবে।’ জানা গেছে, হার্ভি ওয়াইনস্টিন কাণ্ড নিয়ে নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ‘সিটিজেন হার্ভি’র প্রিমিয়ার হবে কানের ফিল্ম বাজারে। বিবিসির সঙ্গে মিলে এটি যৌথ প্রযোজনা করেছে লাইটবক্স।
প্রায় সব উত্তরই ফরাসি ভাষায় দিয়েছেন থিয়েরি ফ্রেমো। তবে ট্রান্সলেটর যন্ত্র কানে রেখে শোনা গেছে সেগুলোর ইংরেজি অনুবাদ। কানের লালগালিচায় সেলফি নিষিদ্ধ করা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘সেলফি খুবই হাস্যকর ও উদ্ভট একটি ব্যাপার! এই মামুলি বিষয়ের কারণে অনাকাঙ্ক্ষিত বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। এটা যেকোনও পদক্ষেপে ব্যাঘাত ঘটায়, যার প্রভাব পড়ে গোটা উৎসবে।'
২০১৫ সালে প্রথমবার বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন এই উৎসবে এসেও থিয়েরি ফ্রেমোর এমন ইচ্ছের কথা শুনেছিলাম। ওইবারও লালগালিচায় সেলফি নিষিদ্ধ করতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু পরে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন। তবে এবার তিনি অনড়।
সংবাদ সম্মেলন শেষে থিয়েরি ফ্রেমোর কাছে গিয়ে বলে ফেললাম, আপনার সঙ্গে একটা সেলফি তুলতে পারি? প্রশ্নটা শুনে মুচকি হাসলেন তিনি। এরপর সবার উদ্দেশে বললেন, ‘এখানে কিন্তু সেলফি নিষিদ্ধ নয়!’ পুরো কক্ষে তখন পড়ে গেলো হাসির রোল। এরপর আমার মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় হাসিমুখে তাকালেন তিনি। সঙ্গে আমার গলায় ঝোলানো ব্যাজে নামের বানান দেখে দিয়ে দিলেন অটোগ্রাফও!