ঘুরে বেড়ানোর জন্য আইফেল টাওয়ার, লুভর জাদুঘর, নোত্রদাম গির্জা, প্যারিস গেট, মোমার্তসহ পর্যটকদের আকর্ষণ ধরে রাখার মতো জায়গাও প্যারিসে গুনে শেষ করা যাবে না। সবই ছবির মতো। এ যেন শিল্পীর আঁকা ক্যানভাস!
এতসব স্থাপনার ভিড়ে প্যারিসের আবেস এলাকায় জ্যঁহা রিকতুস স্কয়ারে এসে মন জুড়িয়ে গেলো। এখানে আছে ‘লে ম্যুর দে জ্যঁতেম’। এর ইংরেজি করলে দাঁড়ায় ‘দ্য ওয়াল অব আই লাভ ইউ’। এই স্কয়ারের একটি দেয়ালের ঠিক মাঝখানে লেখা ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’। এই কথাটিই পৃথিবীর ৩১১টি ভাষায় লেখা আছে এখানে। সবই হাতে লেখা। সারা বিশ্বে ভালোবাসার কথা জানাতে এগুলোই ব্যবহার করা হয়।
সব ভাষায় প্রেমের শব্দগুলোর সংমিশ্রণ দেখতে বিভিন্ন বয়সী মানুষের সমাগম চোখে পড়ার মতো। তরুণ-তরুণীরা কেউ একা, কেউবা জোড়া হয়ে দেয়াল চিত্রের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে। অনেকে অপলক তাকিয়ে আছেন। কেউবা ভিডিও করতে ব্যস্ত। কেউ আবার খুঁজছেন নিজ দেশের ভাষা।
৪০ স্কয়ার মিটার দেয়ালজুড়ে শিল্পকর্মটি তৈরিতে ব্যবহার হয়েছে ৬১২টি গ্লাসেড লাভা টাইলস। দেয়ালচিত্রে লালরঙা টুকরোগুলো হলো ভাঙা মনের প্রতীক। সব লাল টুকরো একসঙ্গে জড়ো করলে দাঁড়াবে হৃদয়ের আকার। এর ঠিক ওপরে একজন নারীর চিত্রকর্ম। তার পাশে ফরাসি ভাষায় একটি কথা লেখা। কথাটির বাংলা করলে দাঁড়ায়, ‘প্রেম হলো ব্যাধি, তাই আসুন ভালোবাসি!’
১৯৯২ সালে প্রেমিক-প্রেমিকাদের উৎসর্গ করে কিছু একটা করার স্বপ্ন দেখেছিলেন ফ্রেদেরিক বার্দো নামের একজন রোমান্টিক ফরাসি। প্যারিসের পথে পথে বিদেশি পর্যটকদের সঙ্গে আড্ডার সময় এই ভাবনা আসে তার মনে। শুরুতে নিজের ভাই ও পরে বিদেশিদের নিজেদের ভাষায় ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ কথাটি লিখে দেওয়ার অনুরোধ জানান তিনি।
ভালোবাসা ও শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দিতে ২০০০ সালে ক্যালিগ্রাফার ক্লেয়ার কিটোর সহযোগিতায় দেয়ালচিত্রটি গড়েন ফ্রেদেরিক বার্দো। মানুষের সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতি রোমান্টিকতার প্রতীকী হিসেবে ধরা হয় তাদের এই প্রয়াস। দেয়ালটি সারা বিশ্বের প্রেমিক-প্রেমিকাদের উৎসর্গ করেন তারা।
জ্যঁহা রিকতুস স্কয়ারের কাছের এলাকা বোহেমিয়ান মোমার্তকে দেখে হলিউডের সেট মনে হতে পারে। তবে এই মনোরম ও নয়নাভিরাম স্থানেই প্যারিসের সত্যিকারের জীবন সম্পর্কে ধারণা মেলে। নিত্যদিনই প্যারিসের অধিবাসী ও পর্যটকদের মিলনমেলা ঘটে সেখানে। এরমধ্যে জ্যঁহা রিকতুস স্কয়ারই তাদের অন্যতম আকর্ষণ। স্থানীয়রা মনে করেন, পৃথিবীজুড়ে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশের সমার্থক হিসেবে কাজ করছে এটি।
জ্যঁহা রিকতুস ছিল ফরাসি কবি গ্যাব্রিয়েল রন্দোর (১৮৬৭-১৯৩৩) ডাকনাম। তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ১৯৩৬ সালে মোমার্তের কাছে এই জায়গা তৈরি করে নাম রাখা হয় ‘জ্যঁহা রিকতুস স্কয়ার’। এখানকার সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে ফুলের গাছ ও বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ। আদতে এটি একটি ছোট্ট বাগান। এখান থেকেই শুরু আবেস এলাকা। আসা-যাওয়ার পথে একটু ভালোভাবে খেয়াল করলেই চোখে পড়বে জায়গাটি।
‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ দেয়াল দেখার জন্য কোনও টিকিট কেনা লাগে না। সবার জন্য উন্মুক্ত। তবে বিশেষ কিছু দিনে সেখানে ঢোকা যায় না। ১ জানুয়ারি, ইস্টার মানডে, পেন্টেকস্ট মানডে, ১ মে, ৮ মে, ১৪ জুলাই, ১৫ আগস্ট, ১ নভেম্বর, ১১ নভেম্বর ও ২৫ ডিসেম্বর বন্ধ থাকে জ্যঁহা রিকতুস।
প্যারিসের গভীরতম আবেস মেট্রো স্টেশনের পাশেই জ্যঁহা রিকতুস স্কয়ার। ফলে পর্যটকরা অনায়াসেই পৌঁছে যেতে পারেন সেখানে। বাসে চড়েও যাওয়া যায় আবেসে। এজন্য ৩০, ৫৪ ও ৬৭ নম্বর বাস ধরতে হবে। জ্যঁহা রিকতুস স্কয়ারের আশপাশে অনেক খাবারের দোকান, ক্যাফে ও বুটিক। চাইলে কেনাকাটাও করা যায় ফাঁকতালে। ঠিকানা: দ্য ওয়াল অব আই লাভ ইউ, আবেস স্কয়ার-৭৫০১৮ প্যারিস, মোমার্ত, ১৮তম বিভাগ।
জ্যঁহা-রিকতুস স্কয়ারের দেয়ালে ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’: