আজ (২২ ডিসেম্বর) কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আয়োজিত শ্রদ্ধা অনুষ্ঠানে বাবাকে যেন তার গানের কথা দিয়েই উত্তর দিলেন বড় ছেলে সাজ্জাদ হোসেন দোদুল। বললেন, ‘‘বাবা লিখে গেছেন, ‘গাছের একটা পাতা পড়লে, কাছের একজন মানুষ মরলে, কে তার খবর রাখে’। আমি আজকে বাবাকে বলব, বাবার কথাটা ভুল। আজ সারাদেশের মানুষ তাকে দেখেছে, তার খবর রাখছে। এত ভালোবাসা তিনি তার যোগ্যতায় দেশের মানুষের কাছে পাচ্ছেন। সন্তান হিসেবে আমি ধন্যবাদ দিতে চাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, চলচ্চিত্র পরিবার, নাট্য পরিবারসহ এদেশের আপামর মানুষকে।’’
বাবাকে নিয়ে কথা বলতে গিয়ে, বারবার আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন তিনি।
‘আপনারা কতটা ভালোবাসেন বাবাকে, তা সন্তান হিসেবে আমি টের পেয়েছি। পরিবারের পক্ষ থেকে আমরা শুধু আপনাদের কাছে দোয়াই চাইব। আব্বা এদেশের মানুষকে ভালোবেসেছেন, আপনারা তাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে সেই ভালোবাসার প্রতিদান দিয়েছেন। বাবার সঙ্গে থেকে অনেক কিছু দেখেছি। এ মুহূর্তে বাবার বিষয়ে কথা বলতে অনেক কষ্ট হচ্ছে।’ কাঁপা কণ্ঠে বললেন সোহেল আরমান।
আজ (২২ ডিসেম্বর) সকাল ১১টা থেকে বেলা সাড়ে ১২টা পর্যন্ত প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেনকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছে সর্বস্তরের মানুষ।
শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা শেষে মরদেহটি নিয়ে যাওয়া হয় এটিএন বাংলা চ্যানেলের কার্যালয়ে। এরপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় তার দীর্ঘদিনের কর্মস্থল বিএফডিসিতে।
ঝর্না স্পটের সামনে গাড়ি থেকে কফিন নামানোর পরপরই উপস্থিত হন আমজাদ হোসেনের পরিচালনায় মাইলফলক তৈরি করা চলচ্চিত্র ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ ও ‘গোলাপী এখন ঢাকায়’ চলচ্চিত্রের নায়িকা ববিতা ও চম্পা। আমজাদ হোসেনের প্রথম চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেওয়া’-এর নায়িকা বড় বোন সুচন্দাও ছিলেন সঙ্গে।
ববিতা সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমজাদ হোসেনের কাজ সব মাইলস্টোন হয়ে আছে। অসাধারণ গুণী একজন মানুষ। আমি বলব, হি ওয়াজ মাই আইকন। এখন প্রশ্ন হলো, আমজাদ ভাইকে আমরা কীভাবে স্মরণ করব? তিনি বহুগুণে গুণান্বিত একজন মানুষ। তবে আমার দেখা সবচেয়ে ভালো মানুষ তিনি।’
আরও বলেন, ‘আমজাদ ভাইয়ের ছবি বিভিন্ন ফেস্টিভালে নিয়ে গেছি। তার কী যে ভীষণ প্রশংসা পেতাম- আয়োজকরা বলতেন, তোমাদের দেশে যন্ত্রপাতির এত সুযোগ সুবিধা কম। কিন্তু তোমরা এত সুন্দর ছবি বানাও কীভাবে? তার ছবি শুধু যে পুরস্কৃতও হয়েছে, তাই নয়। যেমন চলেছে (ব্যবসা করেছে), তেমনি হাততালি পেয়েছে। এটাই হচ্ছেন আমজাদ ভাই।'
ছবিটির নায়িকা ছিলেন সুচন্দা। তিনি বলেন, ‘চলচ্চিত্র সাহিত্য বা নাটকে যে শূন্যতার সৃষ্টি হলো, তা পূরণ করার নয়। বহু ছবিতে একসঙ্গে কাজ করেছি। কত স্মৃতি! আমজাদ ভাইয়ের সঙ্গে সংলাপ করেছি বহুবার। তা এখন মনে পড়ছে। তার কথা মনে পড়ছে আর হৃদয়টা ভেঙে যাচ্ছে।’
‘আমজাদ ভাইয়ের বেশিরভাগ ছবি ছিল গ্রাম পটভূমি নিয়ে। তিনি গ্রামের ভাষায় কথা বলেছেন। কিন্তু এটা সব শ্রেণির দর্শকরা গ্রহণ করেছেন।’ যোগ করলেন সুচন্দা।
বেলা ১টার সময় মরদেহ এফডিসিতে আনার পর বাদ যোহর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এতে অংশ নেন এটিএম শামসুজ্জামান, রিয়াজ, ফেরদৌস, ড্যানি সিডাক, আরিফিন শুভ, জায়েদ খান, সাইমন সাদিক, পরিচালক মুশফিকুর রহমান গুলজার, বদিউল আলম খোকন, প্রযোজক খোরশেদুল আলম খসরুসহ শত শত মানুষ।
আমজাদ ভাইয়ের ছাত্র ছিলাম আমি। মাঝখানে অনেকদিন গ্যাপ ছিল। আমিও চলচ্চিত্র থেকে দূরে ছিলাম। গত তিন-চার বছর এফডিসির ডিরেক্টর স্টাডি রুমে আমরা নিয়মিত আড্ডা দিতাম। সেখানে স্বাভাবিকভাবে শিক্ষক হয়ে যেতেন আমজাদ ভাই। আড্ডাখানা পরিণত হতো ক্লাসরুমে। সত্যি বলতে আমি এই ক্লাসরুমটা খুব মিস করব। তবে এখন পর্যন্ত তার কাছ থেকে যতটুকু পেয়েছি তা কাজে লাগিয়ে যেতে চাই।’
আমজাদ হোসেনের প্রথম চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেওয়া’ নিয়ে কথা বলেন নায়ক ফারুক, ‘‘অনেকেই জানেন, ‘জীবন থেকে নেওয়া’য় তিনি শুধু অভিনয়ে ছিলেন আমজাদ হোসেন। কিন্তু তিনিই সব কিছু করছেন। সেট থেকে শুরু করে, চিত্রনাট্য- সব। তার সঙ্গে যখন সাক্ষাৎ হয়, মনে হতো না কে অভিনেতা ছিল আর কে পরিচালক? আমজাদ হোসেন একটা জিনিস করতে পেরেছেন, তিনি শিল্পী-কলাকুশলীদের নিয়ে সংসার সাজাতে পেরেছেন।’
আমজাদ হোসেনের সমবয়সী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার। একসঙ্গে পথচলার অনেক গল্প আছে তার স্মৃতিতে। এই সহযাত্রী প্রসঙ্গে তিনি বললেন, ‘আমজাদ ভাইয়ের লেখনী এত সুন্দর ছিল যে, তিনি যদি লেখালেখি নিয়েই থাকতেন, তাহলে বাংলা সাহিত্যে তার অন্যরকম আসন থাকত। আদর্শগত দিক থেকে আমরা আলাদা হলেও, ব্যক্তিগত কাজে তিনি কখনও সেই ছাপ পড়তে দিতেন না। তার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা থাকল।’
বিএফডিসির পর চ্যানেল আইয় প্রাঙ্গণে জানাজা শেষে আমজাদ হোসেনের মরদেহটি নিয়ে যাওয়া হয় তার জন্মস্থান জামালপুরে।
এই চলচ্চিত্রকারের শেষ ইচ্ছানুযায়ী রবিবার (২৩ ডিসেম্বর) সকালে জামালপুরেই সমাহিত করা হবে তাকে।
কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ একুশে পদক, স্বাধীনতা পদকসহ একাধিক রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি।
আমজাদ হোসেন ১৯৪২ সালের ১৪ আগস্ট জামালপুরে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই তিনি সাহিত্যের প্রতি অনুরাগী ছিলেন। পঞ্চাশের দশকে ঢাকায় এসে সাহিত্য ও নাট্যচর্চার সঙ্গে জড়িত হন।
তার নির্মিত চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘বাল্যবন্ধু’, ‘পিতাপুত্র’, ‘এই নিয়ে পৃথিবী’, ‘বাংলার মুখ’, ‘নয়নমণি’, ‘সুন্দরী’, ‘কসাই’, ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’, ‘দুই পয়সার আলতা’, ‘সখিনার যুদ্ধ’, ‘ভাত দে’, ‘হীরামতি’, ‘প্রাণের মানুষ’, ‘সুন্দরী বধূ’, ‘কাল সকালে’, ‘গোলাপী এখন ঢাকায়’, ‘গোলাপী এখন বিলেতে’ প্রভৃতি।
এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি উদ্যোগে উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রখ্যাত এই চলচ্চিত্রকারকে ২৭ নভেম্বর দিবাগত রাতে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে। গত ১৮ নভেম্বর সকালে নিজ বাসায় ঘুমের মধ্যে স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার রাজধানীর একটি হাসপাতাল থেকে জরুরি ব্যবস্থায় ব্যাংককে নেওয়া হয়েছিল তাকে।