জন্মদিনে মমতাজউদদীন আহমদ

‘আমার বাঁচার কোনও যোগ্যতা নেই’

BANGLA ACADEMY--------------------11৮৫তম জন্মদিনের আনন্দ আয়োজনে হাজির হয়ে দেশবরেণ্য নাট্যকার, লেখক, অধ্যাপক মমতাজউদদীন আহমদ বললেন, ‘খুব ভালো লাগছে। অভিভূত হয়ে গেলাম। প্রচণ্ড হতাশ হয়ে গিয়েছি। চিন্তা করতে পারি না, পড়তে পারি না, ভাবতেও পারি না। ঘর ভর্তি বই, স্পর্শ করতে পারি না। ৪৪ বছরের নিয়ম- ডায়েরিটাও লিখতে পারি না এখন। এমনকি নিজের হাতে খেতেও পারি না। শিশুর মতো হয়ে গেছি আমি। আমার বাঁচার কোনও যোগ্যতা নেই, আমি আবর্জনা মাত্র।’

এরপর আবেগতাড়িত হয়ে তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রতিটি ধুলিকণা আমার। মসজিদ, মন্দির, গির্জা, মঠ- সব আমার। পৃথিবীর সেরা দেশ আমার দেশ।’ অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে স্ত্রীর উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘যেতে দাও কুমু, আমার সময় হয়ে গেছে।’

নন্দিত নাট্যজন অধ্যাপক মমতাজউদদীন আহমদ তার জীবন চলার পথে ৮৪ বছর অতিক্রম করে ৮৫তে পদার্পণ করেছেন। এই আনন্দঘন মুহূর্ত উদযাপন করতে দেশের সংস্কৃতি, শিল্প, সাহিত্য অঙ্গণের বিশিষ্টজনের এক মিলনমেলা বসে গত হওয়া সন্ধ্যায়। শুক্রবার (১৮ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে অধ্যাপক মমতাজউদদীন আহমদ-এর ৮৫তম জন্মদিনের আনন্দ আয়োজন হয়। অনুষ্ঠানে এই নাট্যজনকে নিয়ে কথা বলেন কামাল লোহানী, রামেন্দু মজুমদার, মামুনুর রশীদ, আসাদুজ্জামন নূর, নওয়াজীশ আলী খান, মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার (অব) প্রমুখ। সভাপতিত্ব করেন জন্মদিন উদযাপন জাতীয় পরিষদের আহ্বায়ক ও বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি হাবীবুল্লাল সিরাজী। সঞ্চালনা করেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ। শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন ড. নীলুফার বানু।
BANGLA ACADEMY--------------------09
এদিন সন্ধ্যা ছ’টার দিকে অধ্যাপক মমতাজউদদীন আহমদ বাংলা একাডেমিতে পৌঁছান। একটি হুইল চেয়ারে করে তাকে অনুষ্ঠানস্থলে আনা হয়। কণ্ঠশিল্পী ফেরদৌস আরার কণ্ঠে নজরুলের ‘অঞ্জলি লহো মোর’ গানটির পরিবেশনার মধ্য দিয়ে আয়োজনের শুরু হয়। এরপর মমতাজউদদীন আহমদের গায়ে চাদর পরিয়ে দেন নাট্যজন ড. ইনামুল হক। জন্মদিন উপলক্ষে ক্রেস্ট প্রদান করেন আয়োজনের সভাপতি হাবীবুল্লাহ সিরাজী। মমতাজউদদীন আহমেদকে তার একটি প্রতিকৃতি হাতে তুলে দেন শিল্পী কামাল পাশা চৌধুরী ও আইএফআইসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ আলম সারওয়ার। এরপর অধ্যাপক ড. রতন সিদ্দিকী মমতাজউদদীন আহমদ এর শংসাবচন পাঠ করে শোনান।

মমতাজউদদীন আহমদ এর জ্যেষ্ঠ পুত্র ডা. তিতাস মাহমুদ বাবার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আমি জানি আপনার জন্য বেঁচে থাকা কতো কষ্টকর। আপনার ফুসফুসের স্থিতিস্থাপকতা নেই। আপনি বকুলপুরের স্বাধীনতা, বাংলাদেশের সকল আন্দোলন সংগ্রামের নাম আপনি। আপনি বাঁচতে চান না, কিন্তু আপনাকে বাঁচতে হবে। এ দেশের প্রতিটি শিশুর জন্য আপনাকে বাঁচতে হবে।’
BANGLA ACADEMY--------------------12
এ সময় তিনি পরিবারের পক্ষ থেক প্রতিবছর একজন নাট্যকর্মীকে মমতজউদদীন আহমদ নামাঙ্কিত একটি পুরস্কার প্রদানের ঘোষণা দেন, যার আর্থিক মূল্য এক লাখ টাকা।
কামাল লোহানী বলেন, ‘মমতাজের রাস্তা নাটকের দিকে, আমার রাস্তা সাংস্কৃতিক সংগঠনের দিকে। ৫২-এর ভাষা আন্দোলনের পর আমাদের বন্ধুত্ব শুরু হয়। সেই বন্ধুত্ব আজও বজায় আছে ও অক্ষুন্ন রয়েছে। আরও কিছুদিন বাঁচতে চাই। মমতাজ, আপনাকেও আমার সঙ্গে বাঁচতে হবে।’

এরপর রামেন্দু মজুমদার বলেন, ‘৬৮ সালে আমি চৌমুহনী কলেজে অধ্যাপনা করি। একটি আয়োজনে দেখলাম একজন মানুষ অসাধারণ ধারাভাষ্য দিচ্ছেন। তিনি মমতজউদদীন আহমদ। তিনি একজন নাটক পাগল মানুষ। নাটক নিয়ে তার সঙ্গে অনেক স্মৃতি। তিনি যখন যেখানে থাকেন জমিয়ে রাখেন। তিনি অসুস্থ থাকলেও লেখালেখি চালিয়ে যাবেন এটাই প্রত্যাশা করি।’
মামুনুর রশীদ বলেন, ‘বাংলা সাহিত্য একসময় খুব অধ্যাপক শাষিত ছিল। নাটকও তার বাইরে নয়। কিন্তু আমার সেটা ভালো লাগতো না। তাই আমি মমতাজউদদীনকে ভাই বলতাম। ১৯৭১ সালে চট্টগ্রামে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে তার একটি বিরাট ভূমিকা ছিল। তিনি হিউমারাস সংলাপে অনেক কঠিন কথা বলতে পারতেন নাটকে। বয়স বিচারে নয় কাজের বিচারে তিনি আজও তরুণ।’
BANGLA ACADEMY--------------------05
আসাদুজ্জামান নূর বলেন, ‘আমাদের মমতাজ স্যার। অনেক কথা বলা যাবে স্যারকে নিয়ে। কারণ, বিশাল এক পটভূমি জুড়ে তার উপস্থিতি। নাটক, লেখালেখি, অধ্যাপনা থেকে আমাদের ভাষা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালির চেতনার বিকাশ, প্রসারে তার অবদান অনবদ্য। তার সঙ্গে উঠাবসা অনেক আগ থেকে, সেই ৭২-৭৩ সালে। সেই সময়ই তিনি বলেছিলেন, একটা মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলো আরেকটা মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। তাকে আজ হুইল চেয়ারে দেখছি, কিন্তু এটা কোনও ব্যাপার না। বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিন্স জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত হুইল চেয়ারে বসেই বিখ্যাত সব আবিষ্কার করেছেন। স্যারও আমাদের মাঝে আলো ছড়িয়ে যাবেন এ প্রত্যাশা করি।’
অনুষ্ঠানে মমতাজউদদীন আহমদকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানায় বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগসহ দেশের প্রায় অর্ধশতাধিক সংগঠন।