সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কান উৎসবে বাংলাদেশের কয়েকটি ছবি প্রদর্শিত হওয়ার খবর গণমাধ্যমে দেখা গেছে। অথচ সেগুলোর কোনোটিই অফিসিয়াল সিলেকশন নয়! আদতে এসব ছবির নির্মাতারা প্রচারণার বেলায় ‘চালাকি’ করে কান উৎসবের ভাবমূর্তিকে ব্যবহার করছেন বেশিরভাগ সময়। মার্কেট কিংবা প্রফেশনাল স্ক্রিনিং ও ফেস্টিভ্যাল স্ক্রিনিংয়ের পার্থক্য ভুলে বিনা অর্জনে অতি উদযাপন করে তারা নিজেরাই ছোট হচ্ছেন, বাংলা ট্রিবিউন অনুসন্ধানে এমনটাই উঠে এসেছে সম্প্রতি।
কান উৎসবের প্রাণকেন্দ্র পালে দে ফেস্তিভাল ভবনের কাছাকাছি কয়েকটি প্রেক্ষাগৃহসহ দক্ষিণ ফরাসি উপকূলের শহরটিতে আরও অনেক ছবির প্রদর্শনী হয়ে থাকে। এই সুযোগকেই কৌশলে কাজে লাগিয়েছেন বাংলাদেশি নির্মাতারা। এসব প্রেক্ষাগৃহ ভাড়া নিয়ে বিশ্বের অনেক দেশের মতো তারা নিজেদের ছবি চালিয়েছেন। কিন্তু সেগুলো কোনোভাবেই কান উৎসবের অংশ ছিল না। এটি মূলত মার্কেট স্ক্রিনিং। ফেস্টিভ্যাল স্ক্রিনিংয়ের সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই। সুতরাং ‘কানে যাচ্ছে বাংলাদেশের ছবি’ কিংবা ‘কানের অফিসিয়াল সিলেকশন পেয়েছে বাংলাদেশের ছবি’- নিশ্চিত না হয়ে গণমাধ্যমে এমন সংবাদ প্রচার করা অনৈতিক।
এ পর্যন্ত একমাত্র তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’ ছাড়া বাংলাদেশের আর কোনও ছবি কান জয় করতে পারেনি, আজও।
কান উৎসবের অফিসিয়াল সিলেকশনের বিভাগগুলো হলো প্রতিযোগিতা (কম্পিটিশন), আঁ সার্তে রিগার, প্রতিযোগিতার বাইরের বিভাগ (আউট অব কম্পিটিশন) এবং বিশেষ প্রদর্শনী (স্পেশাল স্ক্রিনিংস ও মিডনাইট স্ক্রিনিংস)। কানের ৭২তম আসরে নির্বাচিত ছবিগুলোর নাম ঘোষণা করা হয়েছে ইতোমধ্যে। কিন্তু এতে বাংলাদেশের কোনও চলচ্চিত্র বা পরিচালকের নাম নেই।
কান উৎসবে প্যারালাল বিভাগ হিসেবে ১৯৬২ সালে সিমেন দ্যু লা ক্রিতিক (ইন্টারন্যাশনাল ক্রিটিকস উইক) আর ১৯৬৯ সালে যুক্ত হয় ডিরেক্টরস ফোর্টনাইট। এ দুটি বিভাগে নির্বাচিত ছবিগুলোকেও কানের আয়োজকরা স্বীকৃতি দিয়ে থাকেন। যেমন ক্যামেরা দ’র পুরস্কারের জন্য অফিসিয়াল সিলেকশনের পাশাপাশি এ দুটি বিভাগে নির্বাচিত নবাগত পরিচালককে মনোনয়নে রাখা হয়। অফিসিয়াল সিলেকশনের পাশাপাশি ইন্টারন্যাশনাল ক্রিটিকস উইক ও ডিরেক্টর’স ফোর্টনাইটে নির্বাচিত ছবিগুলোকে পুরস্কারের বেলায় বিবেচনায় রাখে চলচ্চিত্র সমালোচকদের আন্তর্জাতিক ফেডারেশন ফিপরেস্কি।
১৯৬৮ সালে ফ্রান্স জুড়ে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের কারণে কান উৎসব বাতিল হওয়ার পরের বছর ডিরেক্টরস ফোর্টনাইট বিভাগ চালু করে ফরাসি চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি। গত বছর ছিল এর ৫০তম আসর। ডিরেক্টরস ফোর্টনাইটে বাংলাদেশের বলার মতো অর্জন আছে। ২০০২ সালে এতে নির্বাচিত হয়েছিল বাংলাদেশের প্রয়াত নির্মাতা তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’। একই আসরে ছিল রোমানিয়ার ক্রিশ্চিয়ান মুঙ্গিউর ‘অক্সিডেন্ট’, ইতালির মাত্তেও গ্যারোনের ‘দ্য এমবালমার’, চাঁদের মামাত সালাহ হারুনের ‘অ্যাবুনা’, স্কটল্যান্ডের লিন রামসের ‘মরভার্ন ক্যালার’, অ্যান্থনি ও জো রুশোর ‘ওয়েলকাম টু কলিনউড’ প্রভৃতি।
২০০২ সালে ফিপরেস্কিতে সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কার পায় তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’। কানে বাংলাদেশের পাওয়া একমাত্র পুরস্কার এটাই। এরপর গত ১৬ বছরে আর কোনও পরিচালক লাল-সবুজের পতাকা ওড়াতে পারেননি কানসৈকতে। ২০০২ সালে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সমালোচক আহমেদ মুজতবা জামাল ফিপরেস্কির বিচারক ছিলেন। এরপর ২০০৫ ও ২০০৯ সালে আরও দু’বার ফিপরেস্কির বিচারকের আসনে দেখা গেছে তাকে। এ বছর ফিপরেস্কির বিচারক হয়েছেন সাদিয়া খালিদ রীতি। তার মাধ্যমে ১০ বছর পর আবারও কান উৎসবের জন্য ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব ফিল্ম ক্রিটিকসের আমন্ত্রণ পেলেন বাংলাদেশের কোনও চলচ্চিত্র সমালোচক। বাংলাদেশের মেয়েদের মধ্যে তিনিই প্রথম ফিপরেস্কির বিচারক হলেন।
২০১৬ সালের কান ক্ল্যাসিকস বিভাগে অন্যভাবে জায়গা করে নেয় বাংলাদেশ। এতে প্রদর্শিত হয় খান আতাউর রহমান অভিনীত পুনরুদ্ধার করা ধ্রুপদী উর্দু ছবি ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ (১৯৫৮)। এর দৃশ্যায়ন হয়েছিল ঢাকা থেকে ৩০ মাইল দক্ষিণে মেঘনা নদীর তীরে, এক জেলেপল্লীতে। বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ আর এ সময়ের সঙ্গে অর্থবহ ও প্রাসঙ্গিক হিসেবে এটি দেখানো হয় কানে। বাংলাদেশে চিত্রায়িত এটাই প্রথম ছবি, যেটি কান উৎসবের ক্ল্যাসিকস বিভাগে স্থান পায়।
২০১৬ সালের ১৪ মে পালে দে ফেস্তিভাল ভবনের সালে বুনুয়েল প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হয় ‘জাগো হুয়া সাভেরা’। এর সুবাদে দক্ষিণ ফরাসি সমুদ্র উপকূলে উঠে আসে বাংলাদেশের নদীমাতৃক জীবন। আখতার জে. কারদার পরিচালিত এই ছবিতে সহকারী পরিচালক ছিলেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান। ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ই প্রথম তুলে ধরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) মানুষের জীবন-বাস্তবতা। জেলেদের নদীনির্ভর জীবনযাপন ও দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াইয়ের বিরল এক ছবি ভাবা হয় এটাকে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালজয়ী উপন্যাস ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ অবলম্বনে কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের চিত্রনাট্যে তৈরি হয় ছবিটি।
‘অজ্ঞাতনামা’ নিয়ে কান মার্কেটে অংশ নিয়েছিলেন তৌকীর আহমেদ। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কান ফিল্ম কেনাবাচার একটি বৈশ্বিক আসর। সুতরাং এখানে চাইলেই নিজের ছবি নিয়ে যাওয়া যায়। এখন কেউ যদি এটাকে অফিসিয়াল সিলেকশন ভাবে বা লেখে- সেটা তার বোঝার ভুল। এ প্রসঙ্গে এটুকুই বলতে পারি।’
মার্শে দ্যু ফিল্মে সারাবিশ্ব থেকে নির্মাতারা বিক্রয়ের কৌশল প্রয়োগ করে পৃথিবীর খ্যাতনামা সিনেমা ব্যবসায়ীদের কাছে ছবিটির নানা বিষয় তুলে ধরেন। ক্রেতার পছন্দ হলে কিনে বাণিজ্যিকভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মুক্তি দেন। প্রযোজকরা উৎসবের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে নাম নিবন্ধন করে ও প্রদর্শনীস্থল ভাড়া নিয়ে নিজেদের ছবি দেখাতে পারেন। এক্ষেত্রে পালে দে ফেস্তিভাল ভবনে ২৫-৩০ আসনের ছোট কয়েকটি প্রেক্ষাগৃহ আর বাইরে বিভিন্ন হোটেল ও সিনেমা হল ভাড়ায় পাওয়া যায়। সুতরাং মার্শে দ্যু ফিল্মের স্ক্রিনিংয়ের ক্ষেত্রে কান মার্কেটের কথা উল্লেখ থাকা আবশ্যক। কারণ মার্শে দ্যু ফিল্মে কোনও বাছাই প্রক্রিয়া নেই। কান উৎসব কর্তৃপক্ষই বলে থাকে, এগুলোকে প্রিমিয়ার ভেবে ভুল করবেন না।
কান উৎসব চলচ্চিত্রের বৈশ্বিক আসর। সেখানে বাণিজ্যিক ছবির চেয়ে শৈল্পিক ও ভিন্নধারার নির্মাণকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় বেশি। সেজন্যই সারাবিশ্বের প্রতিভাবান নির্মাতাদের মিলনমেলায় পরিণত হয় কান। এই আয়োজনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য অংশ শর্ট ফিল্ম কর্নার। এতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ছোট দৈর্ঘ্যের ছবিগুলো অংশ নিতে পারে। উঠতি নির্মাতাদের জন্য এটি এক অবারিত দুয়ার। এর মাধ্যমে ফিল্ম প্রফেশনালদের সঙ্গে তাদের ভাবনার আদান-প্রদান হয়। নবীন নির্মাতাদের কর্মশালা করাতে আয়োজকরা খ্যাতিমান নির্মাতাদের নিয়ে আসেন। সেমিনার হয়। প্রফেশনাল ও বিভিন্ন ফেস্টিভ্যাল প্রোগ্রামারদের সঙ্গে আড্ডা থাকে। তাদের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখা ও জানার সুযোগ হয়। কর্মশালা করান অস্কার মনোনীত ছবির পরিচালকরা।
তবে কানের শর্ট ফিল্ম কর্নারে ছবি জমা দিলেই স্থান পাওয়া যায় না। কান উৎসব কর্তৃপক্ষের চোখে ‘শিল্পমানসম্মত’ ছবি এই বিভাগে জায়গা পায়। যদিও এটি অফিসিয়াল সিলেকশন নয়। তাই শর্ট ফিল্ম কর্নারে অংশ নেওয়াকে কান উৎসবে নিজের ছবি স্থান পেয়েছে বলা উচিত হবে না নির্মাতার। বেশিরভাগ নির্মাতা স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বিভাগে নির্বাচিত হওয়ার আশায় ছবি জমা দেন। আয়োজকরা কোনও ছবিকে প্রতিযোগিতার বাইরে ফেলে দিলেও শর্ট ফিল্ম কর্নারে রাখেন। তবে প্রতিযোগিতা বিভাগে ছবির দৈর্ঘ্য হতে হয় ১৫ মিনিট সর্বোচ্চ। কিন্তু শর্ট ফিল্ম কর্নারে ৩০ মিনিটের শর্ট ফিল্মও জমা দেওয়া যায়।
শর্ট ফিল্ম কর্নারে অংশ নেওয়া নির্মাতাদের কেউ কেউ মার্কেট স্ক্রিনিং কিনে ক্রেতা ও এজেন্টদের ছবি দেখান। এক্ষেত্রে লাগে মাত্র ১২০ ইউরো। তবে প্রিমিয়ার নয়, এটি হলো প্রফেশনাল স্ক্রিনিং। কারণ এই প্রদর্শনীর উদ্দেশ্য ছবি বিক্রি করা। কানের ভিডিও লাইব্রেরিতে দেখেও ছবি বিক্রি হয়। এক্ষেত্রে বলা যাবে না নিজের ছবি কান উৎসবে যাচ্ছে বা স্থান পেয়েছে।
স্বল্পদৈর্ঘ্য নিয়ে কান উৎসবে যাওয়া নির্মাতা জসিম আহমেদের কথায়, ‘কানের শর্ট ফিল্ম কর্নারে ছবি রাখা কোনও অর্জন নয়। তবে সেখান থেকে ছবিটির পরিবেশনা নিশ্চিত হলে নির্মাতার ক্যারিয়ারের জন্য ইতিবাচক হয়। সুতরাং কানের মার্কেট স্ক্রিনিংকে উৎসবে অংশগ্রহণ বলার অর্থ নিজেকেই ছোট করা।’
তবে কানে ‘মাটির ময়না’র অর্জনের ১৫ বছর পর বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক একটি ঘটনা দেখা যায়। সিনেফঁদাসো বিভাগের লা’এতেলিয়ার কার্যক্রমের ১৩তম আসরে নির্বাচিত হয় ‘শুনতে কি পাও’ খ্যাত নির্মাতা কামার আহমাদ সাইমনের ‘ডে আফটার টুমরো’র চিত্রনাট্য। এটিকে বিশেষভাবে সম্ভাবনাময় ও আশাব্যঞ্জক মনে করছেন উৎসব আয়োজকরা। কানসৈকতে তার আমন্ত্রণ পাওয়া বাংলাদেশের জন্য গৌরবের। কারণ লা’এতেলিয়ার কার্যক্রমে নিজে থেকে অংশ নেওয়া যায় না। লোকার্নো চলচ্চিত্র উৎসবের ‘ওপেন ডোর্স হাব’-এ প্রতিযোগিতায় ছিল ‘ডে আফটার টুমরো’র চিত্রনাট্য। সেখানে নতুন নির্মাতার খোঁজে গিয়েছিলেন ২০০৫ সালে চালু হওয়া লা’এতেলিয়ারের পরিচালক। তার কাজই হলো সারা দুনিয়ার ফেস্টিভ্যাল ঘুরে ঘুরে গুরুত্বপূর্ণ নির্মাতা আর তাদের সম্ভাবনাময় চিত্রনাট্য খুঁজে বের করা। এভাবেই নির্বাচিত হয় ‘ডে আফটার টুমরো’ তথা ‘অন্যদিন’। এর অংশ হিসেবে বিভিন্ন দেশের ফিল্ম প্রফেশনালদের সঙ্গে কয়েকদিন ধরে চিন্তাভাবনার আদান-প্রদান করেন কামার। এছাড়া গ্রাঁ পালেতে ফটোসেশনে অংশ নেন। সেখানে অফিসিয়াল সিলেকশনের ছবিগুলোর অভিনয়শিল্পী ও পরিচালকদের ফটোসেশন হয়ে থাকে। কামারের সঙ্গী ছিলেন প্রযোজক সারা আফরীন। কানে এর আগে ২০১৪ সালে নিজের আরেক ছবি ‘শিকলবাহা’র চিত্রনাট্যের জন্য ‘ল্য ফ্যাব্রিক সিনেমা দ্যু মন্দে’র নির্বাচিত ১০ জন উদীয়মান নির্মাতার একজন হয়ে অংশ নেন তিনি। কানের ৭২তম আসর উপলক্ষে মনোনীত হয়েছে বাংলাদেশি তরুণ নির্মাতা মাহদী হাসানের প্রথম চলচ্চিত্র ‘স্যান্ড সিটি’র পাণ্ডুলিপি। তবে এগুলোও অফিসিয়াল সিলেকশন নয়।
তথাপি কামার আহমাদ সাইমন ও মাহদী হাসানের মতো প্রতিভাবান নির্মাতাদের হাত ধরেই হয়তো একদিন কানসৈকতে লাল-সবুজ পতাকা পতপত করে উড়বে। কান উৎসবের অফিসিয়াল সিলেকশনে জায়গা পেয়ে যাবে বাংলাদেশের ছবি। কিন্তু কিছু নির্মাতার চালাকি আর অতি উদযাপনের কারণে তখন হয়তো গণমাধ্যমগুলো এভাবে সংবাদ শিরোনাম করবে, ‘সত্যিই এবার কানে জায়গা পেয়েছে বাংলাদেশ!’