চলচ্চিত্র দুনিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শোকেস কান উৎসবে এবার নারীদের উপস্থিতি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। কারণ আয়োজকরা গত বছর ২০২০ সালের মধ্যে নারী-পুরুষের সমতা বজায় রাখার অঙ্গীকারে (ফিফটি-ফিফটি) সই করেছে। এর অংশ হিসেবে প্রথমবার মূল প্রতিযোগিতায় জায়গা পেয়েছেন চার নারী পরিচালক। তাদের একজন কৃষ্ণাঙ্গ।
কানের ৭২তম আসরের অফিসিয়াল সিলেকশনে জায়গা পাওয়া ছবিগুলোর মধ্যে ২০টি নির্মাণ করেছেন নারীরা। এর মধ্যে প্রতিযোগিতা বিভাগে চারটি, আঁ সাঁর্তে রিগারে আটটি, স্পেশাল স্ক্রিনিংসে তিনটি ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের বিভাগে আছে পাঁচটি। গত বছর কানে নারী পরিচালকদের মোট ১১টি ছবি ছিল। ২০১৭ সালে ১২টি, ২০১৬ সালে ৯টি ও ২০১৫ সালে তাদের বানানো ৬টি ছবি স্থান পায় কানের অফিসিয়াল সিলেকশনে।
কানসৈকতে গত ১৯ মে জমকালো আয়োজনে চলচ্চিত্রে নারীর ভূমিকাকে উদযাপন করতে সমবেত হন সালমা হায়েক, ইভা লঙ্গোরিয়া, এল ফ্যানিংসহ নামিদামি অভিনেত্রীরা। বড় পর্দায় লিঙ্গ সমতার কথা ব্যাপকভাবে উচ্চারিত হলেও নারীদের অংশগ্রহণ এখনও আশানুরূপ নয় বলে মনে করেন তারা। যদিও চলচ্চিত্র শিল্পের মনোভাব বদলেছে বলে মন্তব্য সমাজকর্মীদের। তাই এর ধারাবাহিকতা বজায় রাখার পক্ষে অভিমত জানিয়েছেন তারা।
কানের ৭২তম আসরের মূল প্রতিযোগিতা বিভাগে নির্বাচিত ২১টি ছবির মধ্যে চারটির পরিচালক নারীরা। এগুলো হলো সেনেগালিজ বংশোদ্ভুত ফরাসি নির্মাতা মাতি দিওপের ‘আটলান্টিক’, ফরাসি পরিচালক সেলিন সিয়ামার ‘পোর্ট্রেট অব অ্যা লেডি অন ফায়ার’, ফরাসি নির্মাতা জাস্টিন ত্রিয়েতের ‘সিবল’ ও অস্ট্রিয়ান পরিচালক জেসিকা হজনারের ‘লিটল জো’। অর্থাৎ মূল প্রতিযোগিতায় নারীদের ছবি এবার ২০ শতাংশের কম।
তবে লিঙ্গ সমতার জন্য কোটার পরিকল্পনা নেই কান উৎসব আয়োজকদের। উৎসব শুরুর আগের দিন কানের পরিচালক থিয়েরি ফ্রেমো সংবাদ সম্মেলনে বলে দেন, ‘নারী হওয়ায় এগুলো অফিসিয়াল সিলেকশনে জায়গা পেয়েছে তা কিন্তু নয়। আমরা নির্মাতাদের নির্মাতা হিসেবেই ভাবি।’
এবারের উৎসবের উদ্বোধনী ছবি ‘দ্য ডেড ডোন্ট ডাই’ ছবির সংবাদ সম্মেলনে ব্রিটিশ অভিনেত্রী টিল্ডা সুইনটনের মুখে শোনা গেছে, ‘১১ দশক ধরে নারীরা চলচ্চিত্র পরিচালনা করছেন। তাদের বানানো ছবির সংখ্যা অসংখ্য। প্রশ্ন হলো, কেন আমরা তাদের সম্পর্কে জানি না।’
কানের ইতিহাসে ৮২ জন নারী নির্মাতার ছবি জায়গা পেয়েছে অফিসিয়াল সিলেকশনে। এর মধ্যে স্বর্ণ পাম জিতেছেন কেবল নিউজিল্যান্ডের জেন ক্যাম্পিয়ন (দ্য পিয়ানো, ১৯৯৩)।
অফিসিয়াল সিলেকশনের চারটি বিভাগে বিচারকদের প্রধানদের মধ্যে লিঙ্গ সমতা অর্থাৎ দু’জন পুরুষ ও দু’জন নারী রাখা হয়েছে। মূল প্রতিযোগিতায় মেক্সিকোর অস্কারজয়ী নির্মাতা আলেহান্দ্রো গঞ্জালেজ ইনারিতু, আঁ সাঁর্তে রিগারে লেবানিজ পরিচালক নাদিন লাবাকি আর স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ও সিনেফঁদাসোতে ফরাসি নির্মাতা ক্লেয়ার ডেনিস, ক্যামেরা দ’র বিভাগে আছেন কম্বোডিয়ান পরিচালক রীতি পান।
এবারে উৎসবে আঁ সাঁর্তে রিগার বিভাগে ১৮টি ছবির মধ্যে নারীরা বানিয়েছেন চারটি। এগুলো হলো ফরাসি দুই নারী নির্মাতা জেবু ব্রেতমান ও ইলিয়া গোবি ম্যাভেলেকের অ্যানিমেটেড ছবি ‘দ্য শোয়ালোজ অব কাবুল’, কানাডিয়ান নারী নির্মাতা মনিয়া শকরির ‘অ্যা ব্রাদারস লাভ’, ফরাসি নারী নির্মাতা মুনিয়া মেদুরের ‘পাপিশা’, মার্কিন নারী নির্মাতা অ্যানি সিলভারস্টাইনের প্রথম ছবি ‘বুল’ ও মরক্কোর নারী নির্মাতা মরিয়ম তুজানির ‘আদম’।
প্রতিযোগিতা বিভাগের বাইরে স্পেশাল স্ক্রিনিংয়ে জায়গা পেয়েছে মার্কিন নারী নির্মাতা পিপ্পা বিয়াঙ্কোর প্রথম কাহিনিচিত্র ‘শেয়ার’, লেইলা কনারসের ‘আইস অন ফায়ার’ ও ব্রিটিশ নির্মাতা এডওয়ার্ড ওয়াটসের সঙ্গে সিরিয়ার নারী নির্মাতা ওয়াদ আল কাতিবের ‘ফর সামা’। এর মধ্যে লেইলা কনারসের জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র ‘দ্য ইলেভেন্থ আওয়ার’ ২০০৭ সালে দেখানো হয় কানে।
শিক্ষার্থী নির্মাতাদের বিভাগ সিনেফঁদাসোতে এবার ছিল তরুণীদের জয়জয়কার। নির্বাচিত ১৫টি ছবির মধ্যে ছয়টিই বানিয়েছেন তারা। এর মধ্যে প্রথম পুরস্কার জিতেছে ফরাসি তরুণী লুই কোরভয়জিয়ের পরিচালিত ‘মানো আ মানো। যৌথভাবে তৃতীয় হওয়া ‘দ্য লিটল সৌল’ বানিয়েছেন পোল্যান্ডের বারবারা রুপিক।
কানের প্যারালাল বিভাগ ডিরেক্টরস ফোর্টনাইটে আছে পেরুর মেলিনা লিয়নের ‘সং উইদাউথ অ্যা নেম’, ব্রাজিলের অ্যালিস ফার্টেডোর ‘সিক, সিক, সিক’, আফগানিস্তানের শাহেরবানু সাদাতের ‘দ্য অরফানেজ’ ও ফরাসি নারী নির্মাতা রেবেকা জোতস্কির ‘অ্যান ইজি গার্ল’।
আরেক প্যারালাল বিভাগ স্যুমেন দ্যু লা ক্রিতিকে পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্রের মধ্যে রয়েছে আর্জেন্টিনার সোফিয়া কিরোস উবেদার ‘ল্যান্ড অব অ্যাশেজ’, ফ্রান্সের অঁদ লেয়া রাপার ‘হিরোস ডোন্ট ডাই’ ও হাফসিয়া হার্জির ‘ইউ ডিজার্ভ অ্যা লাভার’।
অস্কারে ৯১ বছরের ইতিহাসে সেরা পরিচালক হয়েছেন কেবল ক্যাথরিন বিগেলো (দ্য হার্ট লকার, ২০১০)। অস্কারে মনোনয়ন পেয়েছেন মাত্র পাঁচজন নারী পরিচালক। বাকি চারজন হলেন লিনা বার্তম্যুলার (সেভেন বিউটিস, ১৯৭৭), জেন ক্যাম্পিয়ন (দ্য পিয়ানো, ১৯৯৩), সোফিয়া কপোলা (লস্ট ইন ট্রান্সলেশন, ২০০৪) ও গ্রেটা গারউইগ (লেডি বার্ড, ২০১৮)।
গোল্ডেন গ্লোবে ৭৬ বছরের ইতিহাসে সেরা পরিচালক বিভাগে একমাত্র সেরা নারী বারবারা স্ট্রাইস্যান্ড (ইয়েনটল, ১৯৮৪)। ফরাসি অস্কারতুল্য সিজার অ্যাওয়ার্ডের ৪৪ বছরের ইতিহাসে কেবল টোনি মার্শাল (ভেনাস বিউটি ইনস্টিটিউট, ২০০০) একমাত্র নারী হিসেবে সেরা পরিচালক হয়েছেন।
এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১৯৯৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত আমেরিকায় পাঁচ ধরনের নারী চরিত্র বেশি। এগুলো হলো নার্স (৮৯ শতাংশ), সেক্রেটারি (৮১ শতাংশ), শিক্ষিকা (৫৭ শতাংশ), ওয়েট্রেস (৫৩ শতাংশ) ও ক্যাশিয়ার (৪৭ শতাংশ)। ২০০৭ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত হলিউডের সেরা ১২০০ ব্যবসাসফল ছবির মধ্যে নারীরা প্রধান চরিত্রে ছিলেন ২৮ শতাংশ। এই একযুগে ২০-৩০ বছর বয়সী অভিনেত্রীদের সংখ্যা ছিল ২৯ শতাংশ। আর ৩০-৪০ বছরের নারীরা ছিলেন ২৮ শতাংশ।
পুরুষদের যেখানে ২০১৮ সালে গড়ে ৬৫ লাখ ডলার দেওয়া হয়েছে, সেখানে মেয়ে পরিচালকরা পেয়েছেন ২৬ লাখ ডলার। পরিচালকদের চেয়ে সাধারণত তাদের সম্মানী ৪২ শতাংশ কম হয়ে থাকে। ২০১৭ সালে স্ক্রিপ্ট সুপারভাইজর ও অ্যাসিসট্যান্ট স্ক্রিপ্ট সুপারভাইজরের দায়িত্ব সামলেছেন ৯৫ দশমিক ৩ শতাংশ নারী। কস্টিউম ডিজাইনার ও ড্রেসার পদে ৮৮ দশমিক ১ শতাংশ ও হেয়ারড্রেসার আর মেকআপ আর্টিস্টদের মধ্যে নারীরা ছিলেন ৭৪ দশমিক ৪ শতাংশ।
ইউরোপে ২০১৮ সালে নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে ২১ দশমিক ৭ শতাংশ পরিচালনা করেছেন নারীরা। ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত তা ছিল ১৯ দশমিক ৮ শতাংশ। বাজেটের দিক দিয়ে এই অঞ্চলে ২০১৮ সালে পুরুষদের যেখানে গড়ে ৩৭ লাখ ডলার দেওয়া হয়েছে, সেখানে নারী পরিচালকরা পেয়েছেন ১৮ লাখ ডলার। গোটা বিশ্ব মিলিয়ে ৪৭টি চলচ্চিত্র উৎসব হয়ে থাকে। এর মধ্যে নারীরা ৩৮ শতাংশের প্রধান।