‘কিছু মানুষ আমাকেও গালাগালি করবে, স্বাভাবিক’

IMG_1038শিলাজিৎ। দুই বাংলায় সুমন-নচি-অঞ্জনের পথে তিনিও আরেক দৃঢ় পথিক। কথা-সুর-কণ্ঠ তো বটেই, তবে তাকে সংগীত পারফর্মার হিসেবেই বেশি ভালোবাসে ভক্তরা। গা ছমছমে গানের কথা, সঙ্গে গায়কির বৈচিত্র। আর হরবলার মতো পৃথিবীর সব পশুপাখিকে জমা করতে পারেন ঐ গলায়। আবার সুরে-ছন্দে বাঁধা গানের বাইরে যার কথাগুলো হয়ে যায়, মানুষ আর বাস্তবতার মতো শক্ত-স্পষ্ট-কাঠখোট্টা কিছু। কলকাতার জীবনমুখী এ গায়ক এবারই প্রথম এসেছেন ঢাকা এফএম ও গানবাংলা চ্যানেলের একটি অনুষ্ঠানে গাইতে। পরের দিন ঘুমভাঙা সকালের প্রায় পুরোটাই দিলেন বাংলা ট্রিবিউন পাঠকদের জন্য। সঙ্গে ছিলেন প্রতিবেদক ওয়ালিউল মুক্তা। ছবি তুলেছেনসাজ্জাদ হোসেন-

babana-(3)

বাংলা ট্রিবিউন: বাংলাদেশে এবারই প্রথম! কলকাতার শিল্পী বিবেচনায় এই ঘটনা ঢাকার জন্য খানিক অস্বাভাবিক। আসতে এত সময় লাগলো কেন?

শিলাজিৎ: আমি দেশের বাইরে অন্য অনেক জায়গায় গিয়েছি। কিন্তু তারা যেভাবে ট্রিট করে, তা গ্রহণ করা সম্ভব নয়। তাই দেশের বাইরে অন্যদের মতো সচরাচর যাওয়া হয় না।

ট্রিবিউন: বিদেশ নিয়ে আপনার অভিজ্ঞতা সুখকর নয় বলে মনে হচ্ছে।

শিলাজিৎ: অনেকটা তাই। একবার আমেরিকায় বসবাসাকারী এক বাঙালি অধ্যাপক আমার কাছে এল। আমাকে নিয়ে সেখানে গান গাওয়াতে চায়। আমি বললাম, তো কত দেবেন? তিনি আমাকে বললেন, দাদা, একহাজার ডলার। সেখানে ভালো হোটেলে থাকবেন, যাবেন আর গাইবেন। একহাজার ডলার পাবেন।

আমি বললাম, আপনি বেতন পান কত? ২০ হাজার ডলার? পৃথিবীতে কতজন অধ্যাপক আছে, আর কতজন গায়ক? একজন সংগীতশিল্পী একসপ্তাহের জন্য যাবে এক হাজারের ডলারের চেয়েও কমে! তিনি উত্তরে বললেন, দাদা ১ হাজার ডলার মানে তো ৬৬ হাজার টাকা। সেখানে যাচ্ছেন, আসছেন, দেশ ঘুরতে পারছেন।
আমি শুধু তাকে বললাম, আমি কিন্তু সে দেশেই টাকাটা নিচ্ছি। তাহলে কলকাতা এসে শুনে যান। আর নয়তো গায়ক বাদ দিয়ে অন্য কাউকে নিয়ে যান, দেশ ঘোরার জন্য। তারা আসলে টাকা দিয়ে আমাদের মূল্যায়ন করতে চায়।

IMG_1131

ট্রিবিউন: তবে কি ঢাকা-বাংলাদেশ নিয়েও আপনার এমন কোনও ধারণা ছিল! নাকি এখনও আছে?

শিলাজিৎ: না, না। আমি আসলে কারণ খুঁজে পাই না। যে দেশকে এত পছন্দ করি, অথচ আমার সংগীত জীবনের ২৫ বছরের মধ্যে আমি কখনও এখানে আসিনি। এমন তো নয় যে, আমি কোনও রাজনীতিরি সঙ্গে যুক্ত বা বিদ্বেষ আছে। আমি সব সময় এখানে আসতে চেয়েছি মনে মনে। কিন্তু কেউ তো এতদিন আমাকে সাধেনি। হয়তো সেভাবে যোগাযোগ হয়নি। এটা আমার কাছে অদ্ভুত ঠেকে।

ট্রিবিউন: আপনাকে তো কথা-গানে বেশ দুষ্টু হিসেবে পাওয়া যায়। এই দক্ষতা কি ছোটবেলা থেকেই রপ্ত করেছেন?

শিলাজিৎ: সে আর বলতে! পাড়ার লোকেরা বলত, শিলুর প্যান্টের নিচে হুনুমানের একটা লেজ আছে গো? আর বলবেই বা না কেন? এলাকার এমন কোনও পাঁচিল আর গাছ নেই, যেটাতে উঠে বসে থাকতাম না। একবার বাড়ির বাইরে গেলে, আমাকে ধরে কে? আমরা ছিলাম দুই ভাই। দুজনের একই দশা।

cola-1-(3)

ট্রিবিউন: ছিলেন বীরভূমে। এরপর কলকাতায়? ছোটবেলার কথাটা আরও শুনতে চাই।

শিলাজিৎ: আমার শৈশব তো দুরন্ত। আর বন্ধু সমাজে কদর ছিল না- তা নয়। আমার মধ্যে একটা জিনিস সবসময়ই ছিল; তা হলো- আমি নতুন কাজ করতাম। অন্যদের চেয়ে আমাদের খেলার ধরন ছিল আলাদা। অনেক খেলা আমি নিজেই আবিষ্কার করেছি। যেমন একটা উদাহরণ দিই, বাড়ির ছাদে দুই-তিন ফুট জায়গায় একটা ক্রিকেট পিচ বানাতাম। একপ্রান্তে মার্বেল নিয়ে বসতাম। অন্য প্রান্তে থাকত প্লাস্টিকের বোতল। বোতলের পেছনে আমার ভাই। এপার থেকে আমি মার্বেল খেলার মতো করে মার্বেল বোতলে লাগাতাম। যদি লেগে ক্যাচ উঠত আর অপর প্রান্তের জন ধরতে পারত, তাহলে আউট। আবার চার-ছক্কাও হতো। আমাদের উপমহাদেশে এমন অনেক নতুনত্ব হয়, হয়তো কেউ কেউ সৃষ্টিশীল আইডিয়া বের করেন। কিন্তু সেগুলো কেউ কাজে লাগায় না। অথচ উন্নত দেশ হলে তারা ঠিকই ব্র্যান্ডিং করে। আর আমাদের মাথাগুলো যায় আস্তাকুঁড়ে।

IMG_1047ট্রিবিউন: ‘তোদের ঘুম পেয়েছে বাড়ি যা’ গানটি একসময় রাজনীতির আঙিনা কাঁপিয়ে দিল। রাজনীতি না করেও আপনি তখন রাজনীতির মাঠে। বিষয়টি কেমন লাগত?

শিলাজিৎ: এমন হতো ছেলেদের দল একটা মেয়েকে কটু কথা বলেছে। মেয়েটি উল্টো ঘুরে বলে দিয়েছে- তোদের ঘুম পেয়েছে, বাড়ি যা। একবার তো দেখলাম মাছের বাজারে। এক ক্রেতা মাছ কিনতে এসেছে। বিক্রেতাকে মাছের দাম যাচ্ছেতাই বলে দিয়েছে। ক্রেতা বলে উঠে, ঘুম পেয়েছে বাড়ি যা। কী আশ্চর্য! গানটি তৈরির সময় কিন্তু এতটা ভেবে করা হয়নি। প্রথমদিন প্রথম অংশটুকুর তাল-লয় করার জন্য শব্দ তৈরি করছিলাম। খালি এ বাক্যটুকু এসেছিল, তোদের ঘুম পেয়েছে বাড়ি যা, স্বপ্ন দেখ ঘুমের ঘোরে। পরে বাকিটায় শব্দগুলো বসিয়েছি। আমার এ জিনিসটা ভালো লাগত না যে, এসি রুমে বসে তুমি আশার কথা বলবে। আর বলবে- হবে, হচ্ছে, একদিন হবে। তাই আমি তাদের বলতে চেয়েছি, তোদের আসলে ঘুম পেয়েছে।

ট্রিবিউন: আর `স্বাধীনতা’ গানটি নিয়ে কী বলবেন?

শিলাজিৎ: ৯৫-৯৬’ সালের দিকে হবে হয়তো। আমাকে একটি চ্যানেলের জন্য দেশাত্মবোধক গান গাওয়ার কথা বলা হলো। আমি তো চমকে গেলাম। দেশাত্মবোধক গান, তাও আবার আমাকে দিয়ে! আমি কোনও গানই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তারপর তাদের বললাম, যদি বলেন, আমি একটি লিখে গাইতে পারি। আমার প্রতি তাদের আস্থা ছিল। গান লিখলাম। আমার সবসময় মনে হয়েছে, স্বাধীনতার তো কোনও বদনাম নেই। আমরা কেন স্বাধীনতাকে দোষ দিয়ে নিজের ভাগ্য জাহির করতে চাই। আর আমি এখন এ কথা বলার কে? সুযোগ পেলেই তুমি স্বাধীনতার উপর দোষ চাপাবে, গালি দেবে তা তো হতে পারে না। কারণ তুমি তো তখন ছিলে না।

‘স্বাধীনতা’ গানের লিংক:

ট্রিবিউন: এগুলো তো প্রশংসা। গান নিয়ে মন্দ কথা শুনতে হয়নি?

শিলাজিৎ: আমি তো গানে গালাগালি করি, কিছু মানুষ আমাকেও গালাগালি করবে, স্বাভাবিক। ২০০৩-০৪ সালের ঘটনা। আমার অ্যালবাম ‘শিলাজিৎ এর পাগলামি – ফিসফিস’ বের হলো। তখন তো প্রায় এটা নিয়ে তুলকালাম। একবার এক সংবাদ সম্মেলনে আমাকে কিছু প্রশ্ন দিল, উত্তরের জন্য। আমি প্রশ্ন হাতে নিয়ে বুঝতে পারলাম, তারা আমাকে হেনস্তা করতে চায়। একবার একজন তো বলেই বসল, আপনি গাঁজা খেয়ে এগুলো লিখেছেন? আমি শুধু হাসি দিয়েছি। তারা কেমন জানি একটা গ্রুপ হয়ে গেল। খুব চেষ্টা করতে থাকল- আমি যেন বেফাঁস কথা বলে ফেলি। নিজেরাই কয়েকজনকে সাজিয়ে আনল মনোচিকিৎসক, চিকিৎসক বা সংগীত বিশেষজ্ঞ হিসেবে। তাদের কাছে এই গ্রুপটা প্রশ্ন করে মন্তব্য চান। বলেন, আচ্ছা শিলাজিৎ যে এমন গান করেছে, তার মানসিক অবস্থা ঠিক আছে? আর এগুলোর উত্তর তো ততদিনে আমার জানা হয়ে গেছে। তখন ‘আমার এফএম’ রেডিও অ্যালবামের গানগুলো প্রচারের কথা থাকলেও তারা ভয়ে তা করল না। একটি ভিডিও বানিয়েছিলাম, কোনও চ্যানেল তা প্রচার করেনি। এগুলো তো অনেক কথা।

ট্রিবিউন: আপনি মজা করে বলেন, সবাইকে প্রেমিকার চোখে দেখতে চান। প্রথম প্রেমটা কবে ছিল?

শিলাজিৎ: হুম, এটা হবে আমি যখন কেজিতে পড়ি। সেইন্ট পল কেজি স্কুল। এক মেয়েকে প্রতিদিন তার স্কুলে যেতে দেখতাম। তারপর আমি আমার স্কুলে যেতাম। এগুলো বিষয়ে ভাগ্যও সহায় হয় (হাসি)। কলকাতায় আমাদের বাসাছিল, তার বাসা থেকে এক স্টপেজ পরে। তাই আসা যাওয়ার পথে তো দেখা হতোই। তবে তাকে বলার সাহস কখনও কুলায়নি। এর আগে পরেও কিন্তু প্রেমের বেশ কয়েকটা ব্যাচ আমার ছিল! তবে তখন তাকেই বেশি সময় দিয়েছি!

IMG_1156

ট্রিবিউন: আপনার প্যান্টের হাঁটুতে এক ধরনের রঙের ছাপ থাকে। এটা কি নিজেই করেন?

শিলাজিৎ: একটা সময় আমি প্রচুর ছেলেদের গহনা পরতাম। আমার হাত পুরো বোঝাই হয়ে থাকত কবজিবন্ধনী আর বালায়। গলায় থাকত মালা। তারপর দেখলাম, আরে এগুলো তো সবাই পরে। তাই এখন আর কিছু পরি না। তবে প্যান্টে নিজেই জিজাইন করি। হাঁটুর কাছে কিছু রং ছিটিয়ে দিই। হঠাৎ দেখা গেল আমি হলুদ শার্ট পরে মঞ্চে যাব, তখন হাঁটুর ওখানে হলুদ রং দিয়ে একটু আঁকিবুঁকি করি। রঙয়ের প্রলেপ পড়তে পড়তে একেবারে মোটা হয়ে গেছে প্যান্টগুলোর এই অংশ।

ট্রিবিউন: শেষ জিজ্ঞাসা- গান লেখা ও চলচ্চিত্রে অভিনয়ের শুরু কীভাবে?

শিলাজিৎ: প্রথম গান লিখেছিলাম ১৯৭৮ সালে।  তখন একেবারে ছোট। ভগবানকে নিয়ে গান। কঠিন সব কথাবার্তা। আর চলচ্চিত্রটা ঠেকায় পড়ে গিলেছি বলা যায়। স্কটিস চার্চ কলেজে পড়তাম। ওখানে ক্রিয়েটিভদের আলাদা কদর ছিল। আমিও বাড়তি ছাড়ের জন্য অভিনয়ে নাম দিলাম। এর আগে অবশ্য ছোটবেলায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুটি নাটকে কাজ করেছিলাম। আর রূপালি পর্দায় অভিষেক ঋতুপর্ণ ঘোষের কারণে। তিনি আমাকে দেখে বললেন, ওমা! তুই তো দেখতে ভালো, অভিনয় করতে পারিস। ব্যস এভাবেই কলকাতার ১৫-১৬টা ছবিতে কাজ করে ফেললাম।

IMG_1147

/এম/এমএম/