মুখোমুখি

‘আর্বোভাইরাস’ ছাড়লেন সুফি: ব্যান্ড আর করবো না, এটা নিশ্চিত

‘আর্বোভাইরাস’ মানেই সুফি ম্যাভরিক, প্রায় দুই দশক ধরে এটাই জেনে-মেনে আসছেন শ্রোতারা। কিন্তু দীর্ঘদিনের এই বিশ্বাস ও ভাবনায় এবার কিছুটা পরিবর্তন আনতেই হবে। কেননা, ব্যান্ডটি থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন এর প্রাণ-ভোমরা, ভোকাল সুফি।
 
গত জুন মাসেই ব্যান্ড ছাড়ার ঘোষণা দেন তিনি। শুক্রবার (২৩ সেপ্টেম্বর) ছিল ব্যান্ডের হয়ে তার শেষ কনসার্ট। যেখানে আর্বোভাইরাস ভক্তদের আবেগে আপ্লুত হতে দেখা গেছে। ব্যান্ডটির হয়ে সুফি ম্যাভরিক আর স্টেজে উঠবেন না, এটা যেন মেনেই নিতে পারছিলেন না ভক্তরা। শেষ কনসার্টের অভিজ্ঞতা, ব্যান্ড ছাড়ার কারণ এবং আগামীর পরিকল্পনাসহ বিভিন্ন বিষয়ে বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে কথা বলেছেন সুফি-
 
আর্বোভাইরাস-এর হয়ে শেষ কনসার্টে এভাবেই ফ্রেমবন্দি হলেন সুফিবাংলা ট্রিবিউন: ‘আর্বোভাইরাস’ আর সুফি- দুটো সমার্থক হয়ে আছে। সেটি থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেওয়ার প্রেক্ষাপট একটু জানতে চাই।

সুফি ম্যাভরিক: ব্যান্ডের মূল টিম বলতে যেটা বোঝায়, সেটা ছিলাম আমি, রঞ্জন (গিটারিস্ট ও গীতিকার) ও নাফিস (ড্রামস)। সুহার্ত (প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, গিটারিস্ট) অনেক দিন ধরে ব্যক্তিগত কারণে অনিয়মিত ছিল। তাই আমরা তিন জনই ব্যান্ড পরিচালনার চেষ্টা করছিলাম। আমরা সবসময় রঞ্জনের লিরিকে গান করেছি। কারণ, আমাদের মধ্যে চমৎকার বোঝাপড়া ছিল। কিন্তু রঞ্জন ২০১৮ সালের দিকে যুক্তরাজ্যে চলে গেছে স্থায়ীভাবে। ও চলে যাওয়ার পর একটা ধাক্কা আসে। আবার করোনার কারণে প্রায় দুই বছর আমরা বসেই ছিলাম। করোনার পর যখন আবার শুরুর চেষ্টা করছিলাম, তখন সেটা হয়ে উঠছিল না। এই সময়ে আদনানও (বেজ গিটারিস্ট) অস্ট্রেলিয়ায় চলে গেলো। আর অতি সম্প্রতি নাফিসও দেশের বাইরে চলে গেছে। আমি না হয় গত নয় বছর ধরে চাকরি করছি, সেটার পাশাপাশি ব্যান্ডও মেন্টেইন করেছি। কিন্তু ওদের জন্য বিষয়টা নতুন। অন্য কাজের পাশাপাশি তারা ব্যান্ডের কার্যক্রমে সংযুক্ত হতে পারছে না সেভাবে। তাছাড়া একেকজন একেক দেশে থাকায় সময়ের পার্থক্যও একটি বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। দেখা গেলো, একটি গান নিয়ে কথা বলতে অনেক সময় লেগে যাচ্ছে। সবকিছু ভেবে আমার মনে হয়েছে, এভাবে আসলে ব্যান্ড হয় না। 

বাংলা ট্রিবিউন: নতুন সদস্য নিয়েও তো কন্টিনিউ করা যেতো...

সুফি ম্যাভরিক: সে প্রচেষ্টাও যে ছিল না, তা নয়। নতুন যারা যুক্ত হয়েছে, তারা প্রত্যেকেই অসাধারণ মেধাবী। কিন্তু তাদের সঙ্গে গান বানাতে গেলে এটা একেবারে নতুন জার্নি হবে আমার জন্য। তখন এটা আর আগের আর্বোভাইরাস থাকবে না। ফ্লেভার পুরো চেঞ্জ হয়ে যাবে। অন্যরা হয়তো আমার মতো সাহসী পদক্ষেপ নেয়নি যে এটা আমার সেই আর্বোভাইরাস নয়, সুতরাং আমি সরে দাঁড়াচ্ছি। তারা এখনও তাদের অবস্থানে আছে। এদিকটায় তাদের সঙ্গে আমার মনোমালিন্য হচ্ছে, যেটা খুব স্বাভাবিক। যেমন আমরা আগের সদস্যরা মিলে একটি গান বানালাম, কিন্তু মিউজিক ভিডিওতে দেখা গেলো নতুন সদস্যদের। বিষয়টা কেমন হবে? যেহেতু একটি মিউজিক ভিডিওর জন্য তিন মহাদেশ থেকে তিন জন এসে কাজ করতে পারবে না। বাস্তব পরিস্থিতি এটাই। 

মঞ্চে সুফি ও আর্বোভাইরাসবাংলা ট্রিবিউন: তাহলে কি আর্বোভাইরাস এখন অস্তিত্বহীন?

সুফি ম্যাভরিক: না, সুহার্ত যতদিন আছে, আর্বোভাইরাস আছে। আমার কাছে যৌক্তিক কারণ আছে, তাই বের হয়ে এসেছি। এখন সুহার্ত হয়তো নতুন ভোকাল নেবে। তাকে নিজের মতো গড়ে নেবে, যার কাছ থেকে নতুন ধাঁচের গান বের হবে। সেটাই হওয়া উচিত। তাহলে মানুষ বুঝতে পারবে, সুফি যতদিন ছিল, ততদিন ব্যান্ডের সাউন্ড ছিল এরকম; আর এখন নতুন ভোকালে এই পরিবর্তন এসেছে।  

বাংলা ট্রিবিউন: শেষ কনসার্টের পর ভক্তদের মন বিষণ্ন। সুফিকে ছাড়া আর্বোভাইরাস ভাবতে পারছেন না তারা...। 

সুফি ম্যাভরিক: এটা খুবই স্বাভাবিক। এমন যদি হতো, আমি একটা অ্যালবামে কাজ করেছি, তারপর আরেকজন ভোকাল এসে গান করেছে। তা তো না। এজন্য শ্রোতাদের একটা অভ্যস্ততা তৈরি হয়েছে। মানসিকভাবে তারা একটা কমফোর্ট জোনে আছে। এটা থেকে বের হতে একটু সময় লাগবে। আমি মনে করি, ব্যক্তির চেয়ে দল বড়। তাই আশা করবো, তারা শুধু ব্যক্তি সুফিকেই নয়, পুরো ব্যান্ডকে ভালোবাসবে।

বাংলা ট্রিবিউন: এবার একটু পেছনে যাওয়া যাক। মানে গোড়ায়। আর্বোভাইরাসের জন্ম থেকে সম্ভবত আপনি ছিলেন না। দলটির সঙ্গে আপনার সংযুক্তি কবে কীভাবে?

সুফি ম্যাভরিক: আমি আর্বোভাইরাসের দ্বিতীয় ভোকাল। আমার আগে ভোকালে ছিলো শোভন। তারা কয়েকটি শো করেছিলো। কিন্তু শোভনের ভয়েসে গানগুলো সেভাবে যাচ্ছিলো না। আর ওই সময় আর্বোভাইরাসে পারমানেন্ট বেইজিস্টও ছিলো না। তখন আর্টসেলের সেজান ভাই আমাকে ও জিসানকে (বেজিস্ট) নেওয়ার জন্য সুপারিশ করেছিলেন। সেই সুবাদেই ২০০২ সালের শেষ দিকে আমার আর্বোভাইরাসে যুক্ত হওয়া।

বাংলা ট্রিবিউন: শুরুর দিকে কেমন স্ট্রাগল করতে হয়েছিলো আপনাদের?

সুফি ম্যাভরিক: সত্যি বলতে আমাদের শুরুতে তেমন স্ট্রাগল করতে হয়নি। কারণ জি সিরিজ (প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান) তাদের নিজ খরচে আমাদের অ্যালবাম করে দিয়েছিলো। আমরা শুধু গান বানিয়েছি। স্ট্রাগল বলতে গেলে আমাদের দুইজন মূল সদস্য চলে যাওয়াতে আমরা একপ্রকার দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। তারা হলো জিসান (বেজ গিটার) এবং তানিম (ড্রামস)। তবে পরবর্তীতে বেজে আদনান এবং ড্রামসে নাফিজকে পেয়ে আমরা পুরোদমে কামব্যাক করেছিলাম। 

বাংলা ট্রিবিউন: অতীত বলে ব্যান্ড ছাড়ার পর সদস্যদের মধ্যে কপিরাইট বিষয়টি জটিল আকারে ধরা দেয়। যেহেতু বলে-কয়ে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন, সেহেতু আপনাদের মধ্যে এই বিষয়ে সমঝোতা হয়েছে নিশ্চয়ই?

সুফি ম্যাভরিক: আমাদের সবগুলো গান পাঁচ জনের নামেই কপিরাইট করা। আর মেধাস্বত্বের কপিরাইট তো মূলত গীতিকার ও সুরকারের। পারফর্মিং রাইটস হিসেবে কেউ পারফর্ম করতেই পারেন। তাছাড়া নতুন যারা সদস্য আসবেন আর্বোভাইরাসে, তারাও এই পুরনো গানগুলো করতে পারবেন স্বাভাবিক নিয়মেই। এসব নিয়ে কোনও সমস্যা হবে না আমাদের।

বাংলা ট্রিবিউন: এবার ব্যক্তিগত আলাপ। আপনার কণ্ঠ শ্রোতারা এত পছন্দ করেন, এরপরও কেন ব্যান্ডের পাশাপাশি একক গান করেননি?

সুফি ম্যাভরিক: এটা প্রায়োরিটির ব্যাপার। আমি যখন গান করেছি, তখন আমার প্রথম এবং শেষ প্রায়োরিটি ছিল আর্বোভাইরাস। এটা মাথায় রেখেই আমি গান বানিয়েছি। এর পাশাপাশি যদি একক গান করতাম, তাহলে সেটাতে মনোযোগ কম থাকতো। এই সেকেন্ড প্রায়োরিটির কিছু তো ভালো হবে না। 

আর্বোভাইরাস-এর পঞ্চপাণ্ডব, মধ্যমণি সুফিবাংলা ট্রিবিউন: তাহলে আপনি এখন কী করবেন? 

সুফি ম্যাভরিক: আপাতত বিরতি। কারণ, এটা আমার জন্য অনেক বড় ধাক্কা যে এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। অনেক শক্তি সঞ্চয় করে ব্যান্ডকে বলেছি, ‘দোস্ত আমি পারছি না আর’। আগে থেকে যেসব শো চূড়ান্ত ছিল, সেগুলো করবো বলেছি। বিটিভির একটি শো ছিল, সেটা করেছি; আর সর্বশেষ নদী রক্স কনসার্টটি করলাম। আগামীতে কী করবো, সেটা নিয়ে এখনই কিছু ভাবছি না। এত তাড়াহুড়ো নেই। চাকরির পাশাপাশি নিজেকে সময় দেবো এখন। আর আমার আগের কয়েকটি গান বানানো আছে, সেগুলো নিয়ে হয়তো কিছু করতে পারি।

বাংলা ট্রিবিউন: নতুন কোনও ব্যান্ড গঠন করবেন? কারণ, দল ছেড়ে একা চলা সহজ নয়।
 
সুফি ম্যাভরিক: ব্যান্ড আর করবো না, এটা আমি নিশ্চিত। এটা অনেক বড় দায়িত্ব। আরও চার-পাঁচটা সমমনা মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আর্বোভাইরাসে আমাদের মধ্যে যে বন্ডিং ছিল, এরকম কাউকে আমি পাবো না জানি। আমার বয়স এখন ৪১ বছর; এখন এরকম বয়সের আরও চার জন মানুষ, যাদের মতাদর্শ, মিউজিকের রুচিবোধ কাছাকাছি, খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন। এ কারণেই আর কখনও ব্যান্ড করা হবে না। আমার প্রথম এবং শেষ ব্যান্ড আর্বোভাইরাস। 

বাংলা ট্রিবিউন: এই দীর্ঘ জার্নির পেছনের দিকে তাকালে কী মনে হয়?

সুফি ম্যাভরিক: প্রথমেই মনে হয়, আমরা আসলে আরও ভালো করতে পারতাম। তবে যা করেছি, তা খারাপ না। কারণ, প্রত্যেক শো’তে ওঠার আগে আমরা এটা ভেবে উঠতাম যে এটাই আমাদের শেষ শো। এজন্য স্টেজে আমরা সবসময় শতভাগ দেওয়ার চেষ্টা করেছি। কখনও হয়তো আমার গলা ঠিক ছিল না, কখনও অসুস্থ ছিলাম, কিন্তু ওভারঅল ব্যান্ডের এনার্জি কিন্তু ঠিক ছিল। এটাই আসল শক্তি। একটি শো’র কথা মনে পড়ছে, তখন আমার গায়ে হালকা জ্বর ছিল। পরে রঞ্জনের একটি বার্গারের অর্ধেকটা খেয়ে দুটো প্যারাসিটামল খেয়েছিলাম। এরপর স্টেজে উঠে পারফর্ম করে একেবারে গোসলের মতো ঘেমে গিয়েছিলাম। যত যাই হোক, শতভাগ দিয়েছি; গলা ছেড়ে গান গেয়েছি, চিৎকার করেছি। এটাই আসলে রক মিউজিক। 

আর্বোভাইরাসের লগোবাংলা ট্রিবিউন: মিউজিকের পাশাপাশি চাকরিও করছেন অনেক দিন ধরে। শুধু মিউজিক করে জীবিকা নির্বাহ করা যায় না কেন? বাংলা ব্যান্ড মিউজিকের সমৃদ্ধ ইতিহাস থাকার পরও কেন সেই পরিবেশ তৈরি হয়নি? 

সুফি ম্যাভরিক: এই প্রশ্নটা আমাদের প্রথম প্রজন্মের মিউজিশিয়ানদের কাছে করা উচিত। তাদের কারও বিজ্ঞাপন সংস্থা আছে, কারও মাল্টিমিডিয়া এজেন্সি আছে, কারও বাবার জমিদারি আছে। কিন্তু যাদের নেই, তাদের জন্য মিউজিক করে টিকে থাকা খুব কঠিন। আরও ৩০-৪০ বছর আগের কথাও যদি চিন্তা করেন, রেকর্ড লেভেল বা প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলো মিউজিশিয়ানদের স্বার্থ দেখেছে, এমনটা কিন্তু কখনও হয়নি বাংলাদেশে। ক্যাসেটের যুগে কম-বেশি সবার আয় হয়েছিল। কিন্তু এখন গান শোনার প্ল্যাটফর্ম বদলে গেছে। ফলে গান থেকে সরাসরি আয়ের পথও সংকীর্ণ হয়ে গেছে। রেকর্ড লেভেল বলতে এখন কিছু নেই, ওই ইন্ডাস্ট্রিও নেই। এবং এসব বিষয়ে কার্যকর কোনও কর্তৃপক্ষও নেই। যত সংগঠন আছে, সব নামে। তারা জুনিয়রদের ডাকে কেবল নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের সময়। অথচ দিনশেষে জুনিয়র মিউজিশিয়ানদেরই কিন্তু ওই প্ল্যাটফর্মটা দরকার। আজ থেকে দশ বছর পরও এই জিনিসটার উন্নতি হবে না। এরমধ্যেও যারা শুধু মিউজিক দিয়ে জীবন ধারণ করছেন, তাদের স্যালুট। 

বাংলা ট্রিবিউন: আপনাদের পরবর্তী সময়ে যেসব ব্যান্ড এসেছে, তাদের মধ্যে কার বা কাদের গান আপনার ভালো লাগে? 

সুফি ম্যাভরিক: বিশ্বাস করুন, এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া একদমই ঠিক হবে না। কারণ, প্রত্যেকের সাউন্ড কোয়ালিটি, গানের ধরন একদম আলাদা এবং ইউনিক। শুধু তা-ই না, তারা গানের লিরিকেও নতুনত্ব নিয়ে এসেছে। এখন এই ব্যান্ডগুলোর মধ্যে কয়টি টিকে থাকবে আমি জানি না। তবে যারা টিকে থাকবে, তারাই কিন্তু বাংলাদেশের ব্যান্ড মিউজিককে প্রতিনিধিত্ব করবে। আর্বোভাইরাস