টোকিও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের পয়লা দিনে বইলো ইউরোপীয় হাওয়া। এবারের উদ্বোধনী ছবি ছিল খ্যাতিমান জার্মান পরিচালক-আলোকচিত্রী ভিম ভেন্ডার্সের ‘পারফেক্ট ডেজ’। তিনিই উৎসবটির ৩৬তম আসরে প্রতিযোগিতা বিভাগে বিচারকদের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
এবারের ওয়ার্ল্ড ফোকাস বিভাগে রয়েছে ১৯০৫ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশের নারী জাগরণের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়ার গল্প নিয়ে নির্মিত অ্যানিমেটেড ছবি “সুলতানা’স ড্রিম”। নারীপ্রধান চরিত্র নিয়ে এটি পরিচালনা করেছেন স্পেনের ইসাবেল হারগুয়েরার। ৭১তম সান সেবাস্তিয়ান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের প্রতিযোগিতা বিভাগে মনোনীত হয় এই ছবি।
সোমবার (২৩ অক্টোবর) সন্ধ্যায় জাপানের রাজধানীতে টোকিও তাকারাজুকা থিয়েটারে উৎসবের উদ্বোধন হয়। অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে ভিম ভেন্ডার্স ‘পারফেক্ট ডেজ’ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ছবিটি নিয়ে একটি স্বপ্ন দেখেছিলাম। এর মাধ্যমে এমন একটি ছবি বানাতে চেয়েছি যেটি কান চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হবে। স্বপ্ন দেখেছিলাম এটি সেরা অভিনয়ের পুরস্কার জিতবে। তবে স্বপ্নেও ভাবিনি এটি জাপান থেকে অস্কারের সেরা আন্তর্জাতিক কাহিনিচিত্র বিভাগে পাঠানো হবে। কিন্তু স্বপ্ন দেখেছিলাম, এটি টোকিও উৎসবের উদ্বোধনী চলচ্চিত্র হবে এবং জাপানি দর্শকেরা একসঙ্গে বসে ছবিটি দেখবে। তারপর আমি ঘুম থেকে জেগে উঠলাম এবং আপনারা এখন ছবিটি দেখতে যাচ্ছেন।’
গত মে মাসে অনুষ্ঠিত ৭৬তম কান চলচ্চিত্র উৎসবের মূল প্রতিযোগিতায় নির্বাচিত হয় ‘পারফেক্ট ডেজ’। এতে টোকিওর টয়লেট ক্লিনারের ভূমিকায় অনবদ্য নৈপুণ্যের সুবাদে সেরা অভিনেতার পুরস্কার জয় করেন জাপানের কোজি ইয়াকুশো। টোকিও উৎসবের উদ্বোধনী মঞ্চে ভিম ভেন্ডার্সের সঙ্গে ছিলেন তিনি।
ইয়াসুজিরো ওজুর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ১৯৮৫ সালে তাঁকে কেন্দ্র করেই তিনি বানিয়েছেন প্রামাণ্যচিত্র ‘টোকিও-গা’। একই বছর টোকিও চলচ্চিত্র উৎসবের প্রথম আসরে ফেস্টিভ্যাল অব ফেস্টিভ্যালস বিভাগে দেখানো হয় ভিম ভেন্ডার্সের ‘প্যারিস, টেক্সাস’। ১৯৯১ সালে টোকিও চলচ্চিত্র উৎসবের সমাপনী ছবি ছিল তার পরিচালিত ‘আনটিল দ্য এন্ড অব দ্য ওয়ার্ল্ড’। ১৯৯৩ সালে টোকিও চলচ্চিত্র উৎসবের তরুণ নির্মাতাদের ছবির প্রতিযোগিতা বিভাগে প্রধান বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ২০১১ সালে তার ‘পিনা’ দেখানো হয় টোকিওর স্পেশাল স্ক্রিনিং বিভাগে। ১২ বছর পর আবারও টোকিও উৎসবে এসেছেন তিনি। ওয়ার্ল্ড ফোকাস বিভাগে রয়েছে তার নির্মিত ‘আনজেল্ম’। জার্মান চিত্রশিল্পী আনজেল্ম কিফারের ওপর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্রটি ৭৬তম কান উৎসবের স্পেশাল সেশনসে দেখানো হয়।
চীনের সঙ্গে জাপানের কূটনৈতিক সম্পর্কের উন্নতি হচ্ছে। সেই বার্তা দিতেই যেন চীনা পরিচালক ঝ্যাং ইমুকে আজীবন সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে টোকিও উৎসবের উদ্বোধনী আয়োজনে। ৭৩ বছর বয়সী এই নির্মাতা বলেন, ‘এটি আমার জন্য একটি নতুন শুরুর মতো।’
এবারের আসরে মাস্টারক্লাসে অংশ নেবেন ঝ্যাং ইমু, ৭৬তম কান চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা পরিচালকের পুরস্কারজয়ী ফরাসি-ভিয়েতনামিজ নির্মাতা ট্র্যান আন হাং, কানে দুইবার স্বর্ণপাম জয়ী জাপানিজ পরিচালক কোরি-এদা হিরোকাজু, হংকংয়ের অভিনেতা-নির্মাতা টনি লিয়াং।
টোকিও চলচ্চিত্র উৎসবের চেয়ারম্যান আন্দো হিরোয়াসু বলেন, ‘আমরা প্রায় দুই হাজার বিদেশি অতিথিকে স্বাগত জানাতে পেরে খুব খুশি। গত আসরে বিভিন্ন বিধিনিষেধের কারণে বিদেশি অতিথি সংখ্যা ছিল মাত্র ১০০ জন।’
উৎসবের সামনের সারির বিভাগগুলো হলো প্রতিযোগিতা, এশিয়ান ফিউচার, গালা সিলেকশন, ওয়ার্ল্ড ফোকাস, নিপ্পন সিনেমা নাউ, অ্যানিমেশন, জাপানিজ ক্ল্যাসিকস, ইয়ুথ, টিআইএফএফ সিরিজ এবং আউটডোর স্ক্রিনিংস। ‘শোল্ডার্স অব জায়ান্টস’ শীর্ষক আয়োজনে রয়েছে ইয়াসুজিরো ওজুর প্রায় সব চলচ্চিত্র এবং তাকে নিয়ে আলোচনা ও সেমিনার।
ওয়ার্ল্ড ফোকাস বিভাগে আছে ৭৬তম কানে স্পেশাল স্ক্রিনিংয়ে থাকা স্পেনের পেদ্রো আলমোদোভারের ‘স্ট্রেঞ্জ ওয়ে অব লাইফ’ এবং আঁ সাঁর্তা রিগা বিভাগে প্রদর্শিত আর্জেন্টিনার রদ্রিগো মোরেনো পরিচালিত ‘দ্য ডেলিনকোয়েন্টস’।
জাপানের কিংবদন্তি নির্মাতা আকিরা কুরোসাওয়ার প্রিয় কয়েকটি চলচ্চিত্র দেখানো হবে উৎসবে। এগুলো হলো চার্লি চ্যাপলিন পরিচালিত ‘সিটি লাইটস’ (১৯৩১), জ্যঁ-রেনোয়ার পরিচালিত ‘দ্য লোয়ার ডেপথস’ (১৯৩৬), জন ফোর্ডের পরিচালিত ‘দ্য কোয়ায়েট ম্যান’ (১৯৫২), ফ্রাঁসোয়া ত্রুফোঁর ‘দ্য ফোর হান্ড্রেড ব্লোস’ (১৯৫৯) এবং আকিরা কুরোসাওয়ার ‘থ্রোন অব ব্লাড’ (১৯৫৭)।
আউটডোর স্ক্রিনিংসে বিনামূল্যে দেখানো হবে হলিউডের ব্লকবাস্টার কয়েকটি চলচ্চিত্র। এ তালিকায় রয়েছে টম ক্রুজের ‘টপ গান: ম্যাভেরিক’, লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিওর ‘দ্য গ্রেট গ্যাটসবি’, জর্জ ক্লুনি ও স্যান্ড্রা বুলকের ‘গ্র্যাভিটি’, বেন অ্যাফ্লেকের ‘আর্গো’, জেসন মোমোয়ার ‘অ্যাকুয়াম্যান’, স্টিভেন স্পিলবার্গের ‘রেডি প্লেয়ার ওয়ান’, জর্জ ক্লুনি ও ব্র্যাড পিটের “ওশান’স ইলেভেন”, কিয়ানু রিভসের ‘দ্য ম্যাট্রিক্স’, জুলিয়া রবার্টসের ‘এরিন ব্রোকোভিচ’, গল গ্যাডটের ‘ওয়ান্ডার ওম্যান’, সিলভেস্টার স্ট্যালোনের ‘দ্য এক্সপেন্ডেবলস থ্রি’, ‘ক্রেজি রিচ এশিয়ানস’, অ্যানিমেটেড ছবি ‘স্পাইডার-ম্যান: অ্যাক্রস দ্য স্পাইডার-ভার্স’ প্রভৃতি।
প্রতিযোগিতা বিভাগে নির্বাচিত হয়েছে মোট ১৫টি চলচ্চিত্র। এরমধ্যে একটি ছবি পাবে উৎসবের সর্বোচ্চ পুরস্কার টোকিও গ্রাঁ প্রিঁ। আরেকটি ছবিকে দেওয়া হবে অডিয়েন্স অ্যাওয়ার্ড।
হামামাতসুচোর টোকিও মেট্রোপলিটন ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেড সেন্টারে উৎসবের বাণিজ্যিক শাখা টিফকম বসবে ২৫ অক্টোবর থেকে টানা তিন দিন। করোনার কারণে চার বছর পর সশরীরে এর কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হবে।