একটি সিনেমার জন্য টোকিও উৎসবে নতুন বিভাগ!

জাপানের টোকিও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে একসময় হলিউডের ব্লকবাস্টারগুলোর এশিয়ান প্রিমিয়ার হতো নিয়মিত। কিন্তু একদশক ধরে সেই চিত্র দেখা যায়নি। কারণ আমেরিকান হেভিওয়েট প্রযোজনা-পরিবেশনা সংস্থাগুলো চীনের বিকাশমান বক্স অফিসকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে বিপণন বৃদ্ধি করেছিল। অবশেষে সেই দৃশ্যপটে পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

টোকিও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব পুনরুজ্জীবিত করে দিতে পারে হলিউডের বহুল প্রতীক্ষিত ব্লকবাস্টার ‘গ্ল্যাডিয়েটর টু’। শুধু এই একটি ছবির জন্য ‘সেন্টারপিস’ নামের নতুন একটি বিভাগ রাখা হয়েছে উৎসবের ৩৭তম আসরে। আয়োজকদের আশা, ছবিটি জাপানি দর্শকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলবে।

টোকিওতে আগামী ৫ নভেম্বর রিডলি স্কট পরিচালিত ‘গ্ল্যাডিয়েটর টু’র এশিয়ান প্রিমিয়ার হবে। নিজেদের ছবির প্রচার করতে লালগালিচায় হাজির হবেন অভিনয়শিল্পী পল মেসকাল, ডেনজেল ওয়াশিংটন, কনি নিয়েলসেন ও ফ্রেড হেশিঙ্গার। তাদের মধ্যে আইরিশ তারকা পল মেসকাল প্রথমবার টোকিওতে পা রাখবেন।

‘গ্ল্যাডিয়েটর টু’র দৃশ্যে পেদ্রো পাসকাল ও পল মেসকাল‘গ্ল্যাডিয়েটর টু’ নিঃসন্দেহে বহুল প্রতীক্ষিত চলচ্চিত্রের মধ্যে অন্যতম। কারণ ২০০০ সালে মুক্তির পর বিশ্বব্যাপী ৪৬ কোটি ৫৪ লাখ ডলার আয় করে রিডলি স্কটের মাস্টারপিস ‘গ্ল্যাডিয়েটর’। এরমধ্যে জাপান থেকে এসেছিল ১ কোটি ৫৫ লাখ ডলার। ছবিটি মোট পাঁচটি অস্কার জিতেছে। গ্ল্যাডিয়েটর ম্যাক্সিমাস চরিত্রে অনবদ্য নৈপুণ্যের জন্য সেরা অভিনেতা বিভাগে অস্কার জিতেছেন অস্ট্রেলিয়ান তারকা রাসেল ক্রো।

দুই যুগ পর আসছে ‘গ্ল্যাডিয়েটর’-এর সিক্যুয়েল। এবারের পর্ব পরিচালনা করেছেন যথারীতি ব্রিটিশ নির্মাতা রিডলি স্কট। আগেরবার তিনি খরচ করেছেন ১০ কোটি ৩০ লাখ ডলার। এবারের বাজেট ৩০ কোটি ডলার। আগামী ১৫ নভেম্বর যুক্তরাজ্যে ও ২২ নভেম্বর উত্তর আমেরিকায় মুক্তি পাবে এটি। তার আগে টোকিও মাতাতে ছবিটি নিয়ে যাচ্ছে প্যারামাউন্ট পিকচার্স।

গ্ল্যাডিয়েটর (মল্লযোদ্ধা) লুসিয়াস চরিত্রে অভিনয় করেছেন পল মেসকাল। দুর্নীতিবাজ সাবেক সম্রাট কমোডাসের ভাতিজা হিসেবে উচ্চ মর্যাদা থাকা সত্ত্বেও গ্ল্যাডিয়েটরের ভূমিকায় প্রাণপণ লড়াইয়ে নামতে হয় তাকে। অস্ত্র ব্যবসায়ী ও মল্লযোদ্ধাদের পৃষ্ঠপোষক মাক্রিনাস চরিত্রে আছেন আমেরিকান অভিনেতা ডেনজেল ওয়াশিংটন। আগের পর্বের মতো সিক্যুয়েলেও লুসিয়াসের মা লুসিল্লা চরিত্রে অভিনয় করেছেন ডেনিশ তারকা কনি নিলসেন। জেনারেল মার্কাস অ্যাকাসিয়াস চরিত্রে আছেন চিলিয়ান-আমেরিকান তারকা পেড্রো পাসকাল।আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা বিভাগের বিচারক (বাঁ থেকে)টোকিওর আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা ও বিচারকরা

৩৭তম টোকিও উৎসবের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা বিভাগে জমা পড়েছে ১১০টি দেশের ২ হাজার ২৩টি চলচ্চিত্র। সেগুলোর মধ্য থেকে নির্বাচিত হয়েছে ১৫টি ছবি। এরমধ্যে একটি ছবি পাবে উৎসবের সর্বোচ্চ পুরস্কার টোকিও গ্রাঁ প্রিঁ। যাদের রায়ে বিজয়ী চূড়ান্ত হবে সেই বিচারকদের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব সামলাচ্ছেন হংকংয়ের অভিনেতা-পরিচালক টনি লিয়াং। তার নেতৃত্বে বিচারক প্যানেলে আছেন হাঙ্গেরির পরিচালক ইলদিকো আনিয়েদি, জাপানি অভিনেত্রী হাশিমোতো আই, ফরাসি অভিনেত্রী কিয়ারা মাস্ত্রোইয়ান্নি, হংকংয়ের পরিচালক জনি টো।

আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা বিভাগে নির্বাচিত তালিকায় জাপানের চলচ্চিত্র তিনটি। এরমধ্যে তাইওয়ানের সঙ্গে যৌথ প্রযোজনায় তৈরি হয়েছে কাতাইয়ামা শিনজো পরিচালিত ‘লাস্ট ইন দ্য রেইন’। জাপানের অন্য দুটি ছবি হলো ‘শি টট মি সেরেন্ডিপিটি’ ও ‘তেকি কমেত’। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা বিভাগে এছাড়া আছে ফ্রান্সের ‘ইন হিজ ওন ইমেজ’, কলম্বিয়ার ‘আদিয়োস আমিগো’, ব্রাজিলের ‘বুরি ইয়োর ডেড’, পর্তুগালের “দ্য ইংলিশম্যান’স পেপারস”, চীনের ‘বিগ ওয়ার্ল্ড’, ‘মাই ফ্রেন্ড অ্যান ডেলি’ ও ‘দ্য আনসিন সিস্টার’, কাজাখস্তানের ‘ক্যাডেট’, তাইওয়ানের “ডটার’স ডটার”, হংকংয়ের ‘পাপা’, স্লোভকিয়া/চেক প্রজাতন্ত্রের ‘প্রমিজ, আই উইল বি ফাইন’, রোমানিয়া/বেলজিয়াম/নেদারল্যান্ডসের ‘ট্রাফিক’।৩৭তম টোকিও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের অফিসিয়াল পোস্টারউদ্বোধনী আয়োজন

জাপানের রাজধানী টোকিওর তাকারাজুকা থিয়েটারে নাচ-গান ও কথামালায় এবারের আসরের উদ্বোধন হয়েছে গত ২৮ অক্টোবর। এবারের আসরের উদ্বোধন ঘোষণা করেন উৎসবটির চেয়ারম্যান হিরোইয়াসু আন্দো। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জন্য ভিডিও বার্তা পাঠিয়েছেন জাপানের নতুন প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবা। জাপানের চলচ্চিত্র খাতে সরকারি সহায়তা বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। 

অনুষ্ঠানে সশরীরে ছিলেন জাপানের অর্থ ও বাণিজ্যমন্ত্রী মুতো ইয়োজি। গত অস্কারে সেরা ভিজ্যুয়াল ইফেক্টস বিভাগে ‘গডজিলা মাইনাস ওয়ান’ ও এবারের এমি অ্যাওয়ার্ডসে ডিজনির হিট সামুরাই সিরিজ ‘শোগান’-এর সাফল্যের কথা তুলে ধরেন তিনি। 

টোকিও উৎসবের প্রতি আসরে একজন নেভিগেটর নির্বাচন করা হয়। এবার এই দায়িত্ব পেয়েছেন অস্কার মনোনীত জাপানি অভিনেত্রী কিকুচি রিনকো। এবারের অফিসিয়াল পোস্টারে স্থান পেয়েছেন তিনিই। 

অনুষ্ঠানে গান গেয়েছেন ও বাজিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ান গায়িকা ও বেহালাবাদক সারা আলেইন, জাপানি কোতো বাদক লিও, জাপানি ভার্চ্যুয়াল কণ্ঠশিল্পী কেএএফ, ড্রামার অই কাজুয়া, জাপানি নৃত্যশিল্পী ইকেদা মিকা ও সুজুকি ইয়োহেই।

চলচ্চিত্র নিয়ে এশিয়ার বৃহৎ আয়োজনগুলোর মধ্যে টোকিও উৎসব অন্যতম। টোকিও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের ৩৭তম আসর চলছে। জাপানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অভিনয়শিল্পী, প্রযোজক ও পরিচালকরা টোকিওর লালগালিচায় পা রাখছেন। এবারের উৎসবে নির্বাচিত মোট ২০৮টি চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী হচ্ছে টোকিওর বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে।উদ্বোধনী আয়োজনের লালগালিচায় ‘ইলেভেন রেবেলস’ ছবির কলাকুশলীওরা ১১ জন

উৎসবের উদ্বোধনী ছবি ছিল শিরাইশি কাজুয়া পরিচালিত সামুরাই অ্যাকশন থ্রিলার ‘ইলেভেন রেবেলস’। এতে অভিনয় করেছেন তাকায়ুকি ইয়ামাদা, তাইগা নাকানো, সায়াশি রিহো, সাকুমোতো তাকারা, শিহারা সেইজি। ছবিটি তৈরি হয়েছে প্রয়াত কাসাহারা কাজুর অপ্রকাশিত চিত্রনাট্য অবলম্বনে। ২০০২ সালে ৭৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। জাপানের ইতিহাসের অন্যতম ভয়ঙ্কর বোশিন যুদ্ধ এই ছবির পটভূমি। গল্পে দেখা যায়, সামুরাই স্কোয়াডের একদল সদস্য একটি দুর্গ রক্ষার জন্য বীরত্বপূর্ণ অভিযানে নামে। ছবিটির দৈর্ঘ্য আড়াই ঘণ্টার বেশি। গত বছরের আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত এর শুটিং হয়েছে।

জন্মশতবর্ষের সম্মান

১০ দিনের উৎসবটি চলবে আগামী ৬ নভেম্বর পর্যন্ত। সমাপনী ছবি হিসেবে থাকছে ক্রিস্তফ অনোঁরে পরিচালিত ফরাসি-ইতালিয়ান কমেডি ‘মার্সেলো মিয়ো’। গত মে মাসে ৭৮তম কান চলচ্চিত্র উৎসবে এর উদ্বোধনী প্রদর্শনী হয়েছে। এতে নিজের চরিত্রেই অভিনয় করেছেন ফরাসি তারকা কিয়ারা মাস্ত্রোইয়ান্নি। গল্পে প্রয়াত ইতালিয়ান অভিনেতা মার্সেলো মাস্ত্রোইয়ান্নির মতো পোশাক পরেন, কথা বলেন ও আচার-আচরণ করতে থাকেন তিনি। বাস্তবে তারা বাবা-মেয়ে। একপর্যায়ে কিয়ারাকে সবাই ‘মার্সেলো’ নামে ডাকতে শুরু করে। ছবিটিতে তার মা ফরাসি অভিনেত্রী ক্যাথেরিন দেন্যুভ নিজের চরিত্রেই অভিনয় করেছেন। গত ২৬ সেপ্টেম্বর ছিল মার্সেলো মাস্ত্রোইয়ান্নির জন্মশতবার্ষিকী। তার প্রতি সম্মান জানাতে সমাপনী ছবি নির্বাচিত হয়েছে ‘মার্সেলো মিয়ো’।‘ইলেভেন রেবেলস’ ছবির দৃশ্যইরানের তিন

এশিয়ান ফিউচার বিভাগে নির্বাচিত হয়েছে ১০টি চলচ্চিত্র। এরমধ্যে ইরানি ছবি দুটি। এগুলো হলো মোহাম্মদ ইসমাইলি পরিচালিত ‘দ্য বোরা’ ও আশকান আশকানি পরিচালিত ‘ওয়েট আনটিল স্প্রিং’। এশিয়ান ফিউচার বিভাগে আফগানিস্তানের নারী রয়া সাদাত পরিচালিত “সিমা’স সং” ছবিটির দিকে দর্শকদের আগ্রহ থাকবে আলাদাভাবে। এটি যৌথভাবে প্রযোজনা করেছে স্পেন, নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স, তাইওয়ান, গ্রিস ও আফগানিস্তান। একই বিভাগে নির্বাচিত হয়েছে তুরস্কের ‘অ্যাপোলন বাই ডে অ্যাথেনা বাই নাইট’, জাপানের ‘মিসিং চাইল্ড ভিডিওটেপ’, জাপান-তাইওয়ান-যুক্তরাষ্ট্রের ‘ব্ল্যাক ওক্স’, মালয়েশিয়ার ‘পাভান ফর অ্যান ইনফ্যান্ট’, হংকংয়ের ‘ভ্যালি অব দ্য শ্যাডো অব ডেথ’, যুক্তরাষ্ট্রের ‘থ্রি কাস্ট্রেটেড গোটস’ ও “দ্য ভেসেল’স আইল”। এশিয়ান ফিউচার বিভাগের বিচারক ইন্দোনেশিয়ার পরিচালক নিয়া দিনাতা, জাপানি পরিচালক ইয়োকোহামা সাতোকো, জাপানি প্রযোজক ইয়ামাশিতা কোয়ো।

উইমেন’স এমপাওয়ারমেন্ট বিভাগে দেখানো হবে ইরানের সার্বনাজ আলামবেইগি পরিচালিত প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘মেদিগোল’। ইরানে আফগান শরণার্থী কিশোরী মেদিগোলকে কেন্দ্র করে এর গল্প। সামাজিক অবিচার ও সহিংসতার সঙ্গে লড়াই করার পাশাপাশি একজন পেশাদার বক্সার হওয়ার স্বপ্ন দেখে যায় সে।

ওয়ার্ল্ড ফোকাস

২১তম লাতিন বিট চলচ্চিত্র উৎসব হবে টোকিও উৎসবে। এতে থাকছে ভেনিসে স্বর্ণসিংহ জয়ী স্প্যানিশ পরিচালক পেদ্রো আলমোদোভারের ‘দ্য রুম নেক্সট ডোর’। এতে অভিনয় করেছেন জুলিয়ান মুর ও টিল্ডা সুইনটন। 

টিআইএফএফ সিরিজ বিভাগে দেখানো হবে অস্ট্রেলিয়ান তারকা কেট ব্ল্যানচেট অভিনীত ‘ডিসক্লেইমার’ ওয়েব সিরিজের সাত পর্ব। এটি পরিচালনা করেছেন অস্কারজয়ী আলফনসো কোয়ারন। ভেনিস উৎসবে এই সিরিজেরও প্রদর্শনী হয়েছে।

ইরানের ‘ওয়েট আনটিল স্প্রিং’ ছবির দৃশ্যঅন্যান্য আয়োজন

আজীবন সম্মাননা পাবেন হাঙ্গেরির কিংবদন্তি পরিচালক বেলা তার। আকিরা কুরোসাওয়া অ্যাওয়ার্ড পাচ্ছেন তাইওয়ানের নারী পরিচালক ফু তিয়েন-ইয়ু ও জাপানি পরিচালক মিয়াকে শো। মাস্টারক্লাসে অংশ নেবেন জাপানি পরিচালক কিয়োশি কুরোসাওয়া ও হংকংয়ের অভিনেতা স্যামো হাং। উৎসবটি চলছে টোকিওর হিবিয়া-ইয়ুরাকুচো-মারুনুচি-গিনজা এলাকার ছয়টি ভেন্যুতে।

ফিরে দেখা

১৯৮৫ সালে শুরু হয় মর্যাদাসম্পন্ন টোকিও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব (টিআইএফএফ)। ১৯৯১ সাল পর্যন্ত দ্বিবার্ষিকভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে এটি। এরপর থেকে প্রতিবছর হচ্ছে এই উৎসব। ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব ফিল্ম প্রডিউসার অ্যাসোসিয়েশন (এফআইএপিএফ) স্বীকৃত এশিয়ার অন্যতম প্রধান প্রতিযোগিতামূলক চলচ্চিত্র উৎসব হিসেবে টোকিও উল্লেখযোগ্য। এফআইএপিএফ স্বীকৃত একমাত্র জাপানি চলচ্চিত্র উৎসব এটাই।‘গ্ল্যাডিয়েটর টু’র পোস্টার