অনুদান কমিটি থেকে অভিনেত্রীর অব্যাহতি!

স্বচ্ছতা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে চলচ্চিত্রের পাণ্ডুলিপি বাছাই কার্যক্রমের লক্ষ‍্যে ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র অনুদান কমিটি’র অন্যতম সদস্য হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকারের ডাক পেয়েছিলেন অভিনেত্রী জাকিয়া বারী মম। চলচ্চিত্র ও রাষ্ট্রের উপকারের আশায় তাতে হাসিমুখে সম্মত হয়েছিলেন অভিনেত্রী।

 গত বছর ৭ অক্টোবরের খবর এটি।

এরমধ্যে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৩২টি চলচ্চিত্রকে মোট ১৩ কোটি টাকা অনুদান প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়। যা প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশ হয় চলতি বছরের ১ জুলাই। মানে একদিন আগের খবর। যেটি নিয়ে ২ জুলাই দিনভর তুমুল আলোচনা-সমালোচনা চলে। কারণ, খোদ অনুদান কমিটির সদস্যদেরও অনুদান দেওয়ার নজির মিলেছে এবার!

এমন ঘটনার ঠিক একদিন পরই নিশ্চিত হওয়া গেলো, উক্ত অনুদান কমিটি থেকে পদত্যাগ করেছেন জাকিয়া বারী মম! তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনিও সত্যতা নিশ্চিত করেন বাংলা ট্রিবিউন বরাবর।

তবে এটাও জানান, অনুদানের যে প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে ১ জুলাই কিংবা যে সিনেমাগুলো অনুদান পাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারের; সেখানে কমিটির সদস্য হিসেবে তার কোনও অংশীদারত্ব নেই। অর্থাৎ এই নির্বাচিত চলচ্চিত্রগুলো বাছাই ও চূড়ান্তকরণে তার কোনও দায় নেই।জাকিয়া বারী মমমম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি পদত্যাগ বেশ আগেই করেছি। ২৫ মে তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছি। জানিয়েছি, ব্যক্তিগত ও পেশাগত কারণে আমি আর এখানে সময় দিতে পারছি না।’

অভিনেত্রী খানিক অস্বস্তি প্রকাশ করে আরও যোগ করেন, ‘ভালোই হলো আপনারা খোঁজ করেছেন। কারণ, অনুদানের প্রজ্ঞাপন জারির পর বেশিরভাগ খবরে আমার নামটাও চলে আসছিলো কমিটির সদস্য হিসেবে। তাছাড়া অনেকেই নানান প্রতিক্রিয়া আমাকে জানাচ্ছিলো, যেহেতু তারা মনে করছিলেন আমি এই কমিটির সদস্য। ফলে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়া আমার জন্য বেশ অস্বস্তিকর। অথচ আমি এর সঙ্গে নেই গত প্রায় একমাস।’

তবুও প্রশ্ন থাকে, ‘ব্যক্তিগত ও পেশাগত’ ব্যস্ততার উদাহরণ টেনে অব্যাহতি নেয়ার বিষয়টি। কারণ একজন পরীক্ষিত অভিনেত্রী জাকিয়া বারী মম। যিনি রাষ্ট্রের ডাকে, চলচ্চিত্রের উন্নয়নের লক্ষ্যে, সংস্কারের আশায়, নিজের শুটিং ব্যস্ততা ফেলে, রাজপথ থেকে অনুদান কমিটিতে যুক্ত হয়েছিলেন হাসিমুখে।

সেদিনই (৭ অক্টোবর) জাকিয়া বারী মম তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারার জন্য দোয়া চেয়েছেন বাংলা ট্রিবিউন মারফত। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি মনে করি এটা আমার প্রতি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একটা গুরুদায়িত্ব। সেটি আমি সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতে চাই। কাজটা যেন করতে পারি, আমার জন্য দোয়া করবেন সবাই।’

না। করতে পারেননি মম। তারই আভাস মিললো তার কণ্ঠে। ২ জুলাই রাতে মমর প্রতি স্পষ্ট প্রশ্ন ছিলো, কেন এমন হলো?

স্পষ্ট ভাষায় বললেন, ‘কাজ করার সুযোগ ছিল না। নিয়মের বেড়াজাল।’জাকিয়া বারী মমআরেকটু যদি ক্লিয়ার করতেন। পাঠকরা বুঝতে সুবিধে হতো। মম বললেন, ‘এই অল্প সময়ের মধ্যে সংস্কার করে এত পুরাতন নিয়মকানুন সামলে পসিবল হয়ে উঠছিল না। ফলে আগের মতো করেই জিনিসটা আসলে আগাচ্ছিলো। যেখানে আমার কাজ করার আগ্রহটা হারিয়ে ফেলেছি। এখানে আসলে অভিযোগের কিছু নেই। এটা আমাদের সিস্টেমের জটিলতা। সঙ্গে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা তো আছেই।’

কিন্তু বিপ্লব শেষে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন এবং বিভিন্ন বিষয়ে কমিটিগুলো পুনর্গঠনের মূল কারণই ছিলো পুরনো সিস্টেমে সংস্কার করা। যার ভেতর দিয়ে মানুষ সুফল ভোগ করবে। অধিকার ও ন্যায় নিশ্চিত হবে। তাহলে সরকারের ১০ মাস আর জাকিয়া বারী মমর ৭ মাসের সরকারি অভিজ্ঞতা এবং অব্যাহতি কী বার্তা বহন করে?

মমর ভাষায়, ‘এটাই বহন করে, আমি পারছি না তাই অব্যাহতি নিলাম। যেন আমার বদলে অন্য কেউ এসে কাজটা সঠিকভাবে করতে পারে।’

বলা দরকার, জুলাই বিপ্লবে শিল্পী অধ্যায়ে জাকিয়া বারী মম অন্যতম ফ্রন্ট লাইনার ছিলেন। বরাবরই যার ভেতরে ছিলো দেশাত্মবোধ। তিনি ছিলেন সংস্কারের দাবি তোলা অন্যতম অভিনেত্রী। তাহলে সংস্কারের বিপরীতে পুরনো সিস্টেমের কাছেই পরাজিত হলেন মম? শুধুই কি পুরনো আইনের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা?

‘ওরা ৭ জন অভিনেত্রী’ বললেন, ‘আমি গিয়েছিলাম রাষ্ট্রের জন্য কাজ করতে। সেটা পারিনি বলেই ফিরে আসা নিজের কাছে। আর কিছু নয়।’জাকিয়া বারী মমকিন্তু সংস্কারটা তো জরুরি এখনও। মম পারেননি বলে আর কেউ কি পারবেন না? কিন্তু কী সেই সংস্কার। জটিলতা আসলে কোথায়? কেন বার বার সরকারি অনুদান থেকে জাতীয় পুরস্কারগুলো বিতর্কিত হয়। তাজা রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে যেমনটা হয়েছে এবারও। মমর প্রতি আবেদন ছিল, যেন তার অভিজ্ঞতাটুকু শেয়ার করেন, যে পথ ধরে সংস্কারের ইচ্ছাটা টিকে থাকবে, অন্য কারও কদমে।   

জাকিয়া বারী মম এবার খানিকটা কণ্ঠ খুললেন। বাংলা ট্রিবিউনকে বললেন, ‘আমাদের বৈশিষ্ট্যগত পরিবর্তন না হলে খুব ডিফিকাল্ট, পরিবর্তন আনা। নিষ্ঠার সাথে কাজটা করতে হবে। কাজ না করি, অন্তত দুর্নীতিটা করবো না। দুর্নীতি আমাদের মগজে ঢুকে গেছে। আমি এগুলো অভিযোগ করছি না। আমি যা বলছি, ওভারঅল। পুরো রাষ্ট্র কাঠামোটাকে আমার তাই মনে হয়েছে। এটাও মনে হলো এবার, ক্ষমতার কাছে গেলে সবার কেমন জানি চেহারা পাল্টে যায়। এটা দুঃখজনক। আমি আমার পুরনো চেহারাটা পাল্টাতে চাইনি। তাই ফিরে আসা।’

এই ফিরে আসা প্রসঙ্গে অভিনেত্রী আরও জানান, ‘আমার যেহেতু ব্যক্তিগত কোনও চাওয়া পাওয়া নাই ক্ষমতার কাছে, শুধু কাজটাই করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেটা হয়নি। তাই ভাবলাম আমার ছেড়ে দেয়া পদে অন্য কেউ এসে অনেক কাজ করলে সেটা ভালো হবে কমিটির জন্য।’

এদিকে খোঁজ মিলেছে অনুদানের পূর্ণদৈর্ঘ্য কমিটি থেকে আরও অব্যাহতি নিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিস বিভাগের শিক্ষক ও অভিনেতা-নির্দেশক ড. আবুল বাশার মো. জিয়াউল হক (তিতাস জিয়া) এবং নির্মাতা ও সম্পাদক সামির আহমেদ। তারাও পদত্যাগপত্রে ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়েছেন। জাকিয়া বারী মম‘পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র অনুদান কমিটি’র বাকি সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন পদাধিকার বলে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (চলচ্চিত্র), তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএফডিসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও প্রযোজক খান শারফুদ্দীন মোহাম্মদ আকরাম (আকরাম খান), চলচ্চিত্র নির্মাতা ও চিত্রনাট্যকার নার্গিস আখতার এবং রেইনবো চলচ্চিত্র সংসদের সভাপতি আহমেদ মুজতবা জামাল।

আর এই কমিটির সভাপতি হিসেবে আছেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। শুরুতে যে পদে ছিলেন সাবেক উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম।

আরও: 

অতঃপর অনুদান কমিটিতে মম

১৩ কোটি টাকা অনুদান পাচ্ছে ৩২টি চলচ্চিত্র