ছায়ানটের বর্ষবরণ ১৪২৩

সূর্যোদয়ে ধ্বনিত হলো মানবতার মর্মবাণী




রমনা বটমূলে বর্ষবরণ

নতুন সূর্যোদয় যেন সকল জরাকে জানিয়েছে বিদায়। জীর্ণ-পুরনো, অশুভ ও অসুন্দর সবকিছুকে পেছনে ফেলে নতুনের কেতন উড়িয়ে আবার এলো পহেলা বৈশাখ। মানবতার মমর্বাণী কণ্ঠে নিয়ে সূচনা হয়েছে নতুন দিনের, নব জীবনের। আজ (বৃহস্পতিবার) প্রথম সূর্যোদয়ের সঙ্গে সমবেত কণ্ঠে রমনার বটমূল হয়ে পুরো দেশে বুঝি সমস্বরে ধ্বনিত হলো- এসো হে বৈশাখ এসো এসো এসো…। স্বাগত বঙ্গাব্দ ১৪২৩।

বৈশাখকে বরণ করতে সেজেছে সারাদেশ। আর সেই আয়োজনের কেন্দ্রবিন্দু ছিলো রমনার বটমূলে প্রধান বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। বর্ণাঢ্য এ আয়োজনে এবারও ঘাটতি ছিলো না। কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যদিয়ে ভোর ঠিক সোয়া ছয়টায় বটমূলে শুরু হয় বর্ষবরণের আনুষ্ঠানিকতা। যার আয়োজক ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট।

ছায়ানট মনে করে, এবার এমন এক সময়ে বাংলা নববর্ষের আগমন যখন দেশ চলছে এক কঠিন পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে। দেশ যে অর্থনৈতিকভাবে অনেকটাই এগিয়েছে তার নিদর্শন খালি চোখেই স্পষ্ট। সেই সঙ্গে চোখে পড়ে শুভ চেতনা, মানবিকতা বোধ আর কল্যাণ মানসিকতার চরম অবমাননা আর বিনাশের চিত্র। হিংসা, হানাহানি আর নারীর প্রতি নির্যাতন হয়ে উঠেছে নিত্য দিনের ঘটনা। এমনি এক পরিস্থিতিতে হাজির হলো বাঙালির জীবনে আরেকটি নববর্ষ। এ কারণে ছায়ানটের কাছে ১৪২৩ বঙ্গাব্দের প্রথম সূর্যোদয়ের তাৎপর্য ছিল ভিন্নতর। এ যেন শুধুই নতুন বছরকে আহ্বান জানানো নয়, এবারের নববর্ষ প্রকৃত অর্থে বাঙালি জাতির নতুন করে জেগে ওঠার তাগিদ। 

আরও পড়ুন- বর্ষবরণ: ভিড় দেখে নিরাপত্তা দেবে পুলিশ

তাইতো রমনা বটমূলে আয়োজিত এবারের বর্ষবরণের মূল বিষয় ছিলো- ‘মানবতা’। বরাবরের মতো এবারের অনুষ্ঠানও শুরু হয়েছে ভোর সোয়া ছ’টায়। ভোরের রাগালাপ দিয়ে সূচনা। দুই ঘণ্টার কিছু বেশি ব্যাপ্তিকালের অনুষ্ঠান শেষ হয় সকাল সাড়ে ৮টায়। ১৫টি একক গান, ১২টি সম্মেলক গান, ৩টি আবৃত্তি ও পাঠ দিয়ে সাজানো ছিলো পুরো অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানের সমাপনী ঘটে ছায়ানট সভাপতি সন্‌জীদা খাতুনের শুভেচ্ছা কথনের মাধ্যমে।


অসুস্থতার কারণে রমনা বটমূলের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে আসতে পারেননি ছায়ানটের সভাপতি সানজিদা খাতুন। তার লিখিত বক্তব্য পাঠ করে শোনান ড. সারোয়ার আলী। সানজিদা খাতুন বটমূলে দাঁড়িয়ে মানবতার প্রতি শপথ নেওয়ার ও দেশের মানুষের জন্য কিছু করার প্রতিজ্ঞা করার আহ্বান জানিয়েছেন।

এর আগে অনুষ্ঠানে সম্মেলক পরিবেশনার মধ্যে ছিলো- আনন্দধ্বনি জাগাও গগনে, আমরা তো উজ্জ্বল সূর্য, ভোর করে যাই কালরাত্রি, আমি ভয় করব না ভয় করব না, আমি মারের সাগর পাড়ি দেব, ওই মহামানব আসে, টলমল টলমল পদভরে বীরদল চলে সমরে, বল ভাই মাভৈ মাভৈ, নব যুগ ঐ এল ঐ, বাংলা ভূমির প্রেমে আমার প্রাণ হইল পাগল, বাংলা মা’র দুর্নিবার আমার তরুণ দল, মানুষ ছেড়ে খ্যাপা রে তুই, সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে এবং হবে জয়, হবে জয়, হবে জয় রে।রমনায় ছায়ানটের বর্ষবরণ

এদিকে একক কণ্ঠে পরিবেশনার মধ্যে ছিলো-আমি কেমন করিয়া জানাব, আর নহে আর নয়, একদিন যারা মেরেছিল তারে গিয়ে, ও মাঝি ভাই বাইয়ো, কোন কুসুমে তোমায় আমি, গগনে প্রলয় মেঘের মেলা, জাগ সকল জাগ জাগ সকল, দুর্গম গিরি কান্তার মরু, বাঁধন ছেঁড়ার সাধন হবে, ভাইয়ের দোরে ভাই কেঁদে যায়, যেখানে সাঁইর বারামখানা এবং সবারে বাস রে ভালো।
মোট দেড়শ শিল্পীর অংশগ্রহণে পুরো অনুষ্ঠান সাজানো হয়। এর মধ্যে এককভাবে সংগীত পরিবেশন করেছেন- আবদুল ওয়াদুদ, আবুল কালাম আজাদ, আফসানা রুনা, ইলোরা আহমেদ শুক্লা, এটিএম জাহাঙ্গীর, খায়রুল আনাম শাকিল, চন্দনা মজুমদার, মহিউজ্জামান চৌধুরী, লাইসা আহমদ লিসা, লায়েকা বশির, শারমিন সাথী ইসলাম, সত্যম কুমার দেবনাথ, সেমন্তী মঞ্জরী, সেঁজুতি বড়ুয়া এবং সুমন মজুমদার।

এছাড়া একক পাঠ-আবৃত্তি করেছেন- তাপস মজুমদার, দেওয়ান সাইদুল হাসান এবং মাছুমা জাহান।

গত পাঁচ বছরের মত এবারও পুরো অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করছে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতার।

আরও পড়ুন- পহেলা বৈশাখ উদযাপন করবে না সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট


ছায়ানটের শিল্পী-কর্মীদের জন্য নির্দিষ্ট বটমূল সংলগ্ন সামান্য কিছু জায়গা ছাড়া গোটা রমনা অঙ্গনই ছিলো সকলের জন্য উন্মুক্ত। বটমূলের বর্ষবরণ আয়োজন সুষ্ঠু রাখতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনীর পর্যাপ্ত উপস্থিতি ছিলো চোখে পড়ার মতো।

এদিকে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রমনা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে নেমেছে মানুষের ঢল। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বৈশাখ বরণে সবাই যেন নেমেছে পথে। মনের রং ফুটেছে পোশাকে। রঙিন সাজে সেজেছে সবাই। ঢোলের বাদ্য দিচ্ছে জানান, প্রাণে প্রাণে বৈশাখের তান।রমনার প্রবেশপথে আইনশৃঙ্খলা বানিহীর সদস্যরা

প্রসঙ্গত, বটমূলের আয়োজনের এবার ৪৯ বছর। ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন পাকিস্তান আমলের প্রতিকূল পরিবেশে বাঙালির আপন সত্তা জাগিয়ে তোলা এবং আপন সংস্কৃতিতে বাঁচবার বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করার মানসে বাংলা বছরকে আবাহন জানাবার উদ্যোগ নেয় ছায়ানট। বিগত প্রায় পাঁচ দশক ধরে দেশপ্রেমে সমৃদ্ধ পূর্ণাঙ্গ বাঙালি হয়ে ওঠার, পুরাতনের আবর্জনা দূর করে নতুন সৃজনের প্রত্যয়ে উদ্দীপ্ত হবার, মানুষকে ভালবেসে সবার সাথে মিলে নবযাত্রায় সামিল হওয়ার প্রেরণাসঞ্চারী প্রভাতী সংগীতায়োজন করে আসছে মানুষের ভালবাসাধন্য এই সংগঠন। প্রাণিত করেছে আপামর বাঙালিকে। দিনে দিনে বাংলা নবর্বষের অনুষ্ঠান প্রসারিত হয়েছে সারা দেশে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপন আজ বাঙালির সবচেয়ে বড় মিলনমেলা, রূপান্তরিত হয়েছে এক জাতীয় উৎসবে।

আরও পড়ুন- দেশব্যাপী জমে উঠেছে বৈশাখী অর্থনীতি

এমএম/এমএসএম / এপিএইচ/