৭৬তম কান উৎসব

শেষ হলো সিনেমার বাজার, চমকে দিলো মালয়েশিয়া

আলাদা বিষয় হলেও দুটো ঘটনা একই সময়ের। একটি বিরহের, অন্যটি আনন্দের। দুটোই ঘটেছে জমকালো কান চলচ্চিত্র উৎসবের নবম দিনে (২৪ মে) সন্ধ্যার পর।

এদিন শেষ হয় কান উৎসবের সবচেয়ে বড় জায়গাজুড়ে থাকা সিনেমার বাজার মার্শে দ্যু ফিল্ম বিভাগের কার্যক্রম। পালে দে ফেস্টিভ্যাল ভবনের নিচতলার পুরোটা ধরে লেকপাড়ে সাজানো হয় বরাদ্দ নেওয়া স্টল ও প্যাভিলিয়ন। এবার দেখা গেছে ৫৬ দেশের সাগরঘেঁষা প্যাভিলিয়ন। আর পালে ভবনের নিচতলায় বাংলাদেশের বিএফডিসি-সহ স্টল ছিল চার শতাধিক।

মার্শে দ্যু ফিল্মের প্রধান ফটকগত ১৬ মে উৎসব উদ্বোধনের সঙ্গে কানের সিনেমা বাজার খুলে যায়। বিভিন্ন দেশ ও প্রতিষ্ঠানের সিনেমা বিকিকিনি ও প্রচারণা-পরিবেশনার জমজমাট আয়োজন এটি। এর শেষটা হলো বুধবার (২৪ মে) সন্ধ্যা ঠিক সাড়ে ৬টায় (বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ১০টা)।

মূলত উৎসবের এই অংশেই এবার প্রথম যুক্ত হয় বাংলাদেশের নাম। নেওয়া হয় প্রথম কোনও স্টল। যা নেওয়া হয়েছে তথ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বাংলাদেশ ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন (বিএফডিসি)-এর নামে। স্টলটি যারা নিয়েছেন, শেষ পর্যন্ত তারা আসতে পারেননি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতায়। তবে একই ব্যানারে এবারের সিনেমা বাজারে বাংলাদেশ থেকে এসেছিলো একমাত্র ছবি ‘মা’। এফডিসি কর্তৃপক্ষের অনুপস্থিতিতেও ২০ মে এর নির্মাতা অরণ্য আনোয়ার অনেকটা একাই উৎসব কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রিমিয়ার করেন পালে ভবনের পালে-ই সিনেপ্লেক্সে। এবারের উৎসব থেকে বাংলাদেশের আপাতত অর্জন এটুকুই।

এর বাইরে বাংলাদেশের স্টলটি মূলত ৯ দিন ধরে পড়ে ছিলো কোনও আনুষ্ঠানিকতা ও প্রচারণা ছাড়া।

শেষদিনে প্রায় ফাঁকা কানের সিনেমা বাজারমার্শে দ্যু ফিল্ম বিভাগ বন্ধের দিন (২৪ মে) সন্ধ্যায় গিয়েও দেখা গেছে বাংলাদেশের স্টলটি ফাঁকা পড়ে আছে। অনেকটা সেই সুর বেজেছে ৯দিন ধরে জমজমাট থাকা অন্য স্টলগুলোও।

এদিন সন্ধ্যায় মার্শে দ্যু ফিল্মের দায়িত্বে থাকা এক তথ্য-কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ হয় বাংলা ট্রিবিউন-এর। তিনি জানান, এবার প্রায় ৪শ স্টল বসেছে এই সিনেমার বাজারে। এরসঙ্গে সৈকত লাগোয়া প্যাভিলিয়ন বা ভিলাও ছিলো অর্ধশতাধিক দেশের। তার মতে, বরাবরের মতো এবারও সিনেমার বাজার ছিলো বেশ জমজমাট। স্বস্তি প্রকাশ করে এই ফরাসি কর্মকর্তা বলেন, ‘দারুণ আয়োজনের মধ্যদিয়ে শেষ হলো এবারের আসর।’

শেষদিনেও কাউকে মেলেনি বাংলাদেশের স্টলে যদিও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এবারের কান উৎসবের সিনেমার বাজার ছিল ‘ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ হাঁটিয়া চলিলো’র মতো! এমনটাই মনে করেন বাংলাদেশ থেকে আসা সিনেমা সমালোচক, নির্মাতা, প্রযোজক ও সাংবাদিকরা। সবাই জানেন, শেষ পর্যন্ত বিএফডিসি কর্তাদের ভিসা হয়নি কানসৈকতে পা ফেলার। কারণ, কর্তারা ভিসার আবেদনই করেছেন মার্শে দ্যু ফিল্ম বন্ধ হওয়ার দুই দিন আগে!

এদিকে একই দিন কান উৎসবের সবচেয়ে বড় বাজার মার্শে দ্যু ফিল্মের বাতি নিভলেও উৎসব চলবে আরও তিন দিন। মূল পর্বের পর্দা নামবে ২৭ মে। সেদিনই কান কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করবেন এই আসরের জয়-পরাজয়ের দীর্ঘ তালিকা। তবে সেই তালিকা প্রকাশের আগেই মার্শে দ্যু ফিল্ম বন্ধের সন্ধ্যায় প্রকাশ হলো ৬২তম ‘কান ক্রিটিকস উইক’ পুরস্কার। যাতে ১০ হাজার ইউরোর ‘গ্র্যান্ড প্রাইজ’ জিতে নেন ‘টাইগার স্ট্রাইপস’ নির্মাতা আমান্ডা নেল ইউ। হরর ঘরানার এই ছবিটি মালয়েশিয়ার এবং এই নারী নির্মাতার প্রথম ছবি।

সব মিলিয়ে বলা যেতে পারে, ৬২তম কান ক্রিটিকস উইকে একরকম ছক্কা হাঁকালো মালয়েশিয়া। অবশ্য ছবিটি যে শুধুই মালয়েশিয়ান, সেটিও সরাসরি বলা যায় না। কারণ, এই ছবিটি নির্মাণের সঙ্গে আরও রয়েছে তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর, ফ্রান্স, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, ইন্দোনেশিয়া ও কাতার।

টাইগার স্ট্রাইফসবলা দরকার, আগেও কান উৎসবের বিভিন্ন শাখায় মালয়েশিয়ান ছবি যোগ দিয়েছে। কুড়িয়েছে প্রশংসাও। তবে আমান্ডা নেল ইউ প্রথম কোনও নারী নির্মাতা, যিনি দেশটির হয়ে কান উৎসবে সমান্তরাল বিভাগে সেরার পুরস্কার জিতে নিয়েছেন।

ক্রিটিকস উইক-২০২৩ সালের জুরি সভাপতি অড্রে দিওয়ান বলেছেন, ‘এটি ছিল চূড়ান্ত তালিকা তৈরির প্রথম চলচ্চিত্র, যা আমরা দেখেছি। এটি সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে।’

‘টাইগার স্ট্রাইপস’ হলো জাফফান নামের এক ১২ বছরের এক বালিকার গল্প। যে তার শরীর সম্পর্কে একটি ভয়ঙ্কর রহস্য আবিষ্কার করে। সমাজের সঙ্গে লড়াই করে সে বুঝতে পেরেছে, তাকে মুক্ত হওয়ার জন্য অবশ্যই সেই শরীরকে আলিঙ্গন করতে হবে, যা সে ভয় পেয়েছিল। সিনেমায় জাফফান একজন গর্বিত ও শক্তিশালী বালিকা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

১২ দিনব্যাপী কান উৎসবের পর্দা নামবে আগামী ২৭ মে। সমাপনী চলচ্চিত্র হিসেবে দেখানো হবে পিক্সার অ্যানিমেশন স্টুডিওর ২৭তম সিনেমা ‘এলেমেন্টাল’। এটি রয়েছে প্রতিযোগিতার বাইরে। একই দিন জমকালো আয়োজনে পালে ভবনের প্রধান অডিটোরিয়ামে প্রকাশ করা হবে ৭৬তম কান উৎসবের প্রতিযোগিতা বিভাগে স্থান পাওয়া বিজয়ীদের নাম। প্রদান করা হবে পুরস্কার।

মূল প্রতিযোগিতার ৯ বিচারকএবারের আসরের মূল প্রতিযোগিতা বিভাগের প্রধান বিচারক হিসেবে আছেন রুবেন অস্টলান্ড। দুইবারের স্বর্ণপাম জয়ী এই সুইডিশ নির্মাতার নেতৃত্বে বিচারক হিসেবে রয়েছেন ‘ক্যাপ্টেন মারভেল’ তারকা ব্রি লারসন, আমেরিকান অভিনেতা পল ড্যানো, মরোক্কান পরিচালক মরিয়ম টুজানি, ফরাসি অভিনেতা দঁনি মিনোশেঁ, জাম্বিয়ান-ওয়েলশ পরিচালক-চিত্রনাট্যকার রুঙ্গানো নিয়োনি, আফগান কথাসাহিত্যিক-নাট্যকার আতিক রহিমি, আর্জেন্টাইন পরিচালক দামিয়ান সিফ্রন এবং স্বর্ণপাম জয়ী ফরাসি পরিচালক জুলিয়া দুকুরনো।

এবারের আসরে মূল প্রতিযোগিতা শাখায় রয়েছে ২০টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ও ১টি প্রামাণ্যচিত্র।