টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে বলা হয়, জয় লাভের পর ট্রাম্প যে দৃষ্টিভঙ্গি দেখিয়েছেন, তা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে-এর দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীত। কেননা, ব্রিটিশ সরকার সিরিয়া সরকারকে সমর্থন করে না। থেরেসা মে-এর অভিযোগ, সিরিয়ার সরকার ‘নৃশংস সহিংসতা’ চলাচ্ছে এবং ‘আসাদকে ছাড়াই’ সিরিয়ার দীর্ঘমেয়াদী ভবিষ্যত নিশ্চিত হতে পারে।
ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসনও অভিযোগ করে আসছেন যে শত শত বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যুর জন্য রুশ সরকার দায়ী। এর মধ্য দিয়ে রাশিয়া যুদ্ধাপরাধ করছে বলেও অভিযোগ করে আসছেন তিনি।
এমন প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিমালায় নাটকীয় পরিবর্তনের আভাসে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দফতরে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউজে প্রবেশের আগে আগে কিভাবে তাকে মানানো যায় তা নিয়ে তৎপরতা শুরু করেছে যুক্তরাজ্য। পরবর্তী দুই মাস ব্রিটিশ সরকার ট্রাম্পকে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদকে উৎখাত করার প্রয়োজনীয়তা বোঝানোর চেষ্টা করবে। এ ইস্যুটিকে ‘সর্বোচ্চ’ গুরুত্ব দেবে ব্রিটেন।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে বলা হয়, কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ট্রাম্পের প্রশাসনের জ্যেষ্ঠ সদস্যদের সঙ্গে দেখা করতে বরিস জনসন যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাবেন। জনসন তাদের বোঝানোর চেষ্টা করবেন, যুক্তরাজ্য বিশ্বাস করে আসাদকে ক্ষমতা ছাড়তে হবে। ব্রাসেলসে ইউরোপের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যকার একটি জরুরি বৈঠক বর্জন করেছেন জনসন। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের পরবর্তী অবস্থাকে ইউরোপ কিভাবে মোকাবেলা করবে তা নিয়ে বৈঠকটি নির্ধারণ করা হয়েছিল।
ওয়াল স্ট্রিটকে দেওয়া প্রথম সাক্ষাৎকারে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, আসাদকে উৎখাত করার চেয়ে সিরিয়ায় আইএসকে পরাজিত করার ওপর বেশি গুরুত্ব দেবে তার প্রশাসন। ওয়াল স্ট্রিটকে ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘সিরিয়া ইস্যুতে অনেক মানুষের চেয়ে আমার ভিন্ন মত রয়েছে। আমার দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে, ‘আপনারা সিরিয়ার সঙ্গে লড়াই করছেন, সিরিয়া আইএস-এর সঙ্গে লড়াই করছে, আপনাদেরকে আইএস থেকে মুক্তি পেতে হবে। রাশিয়া সিরিয়ার সঙ্গে পুরোপুরি যুক্ত হয়ে গেছে। এখন ইরান ক্ষমতাশালী হচ্ছে। এ দেশটিও সিরিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়েছে। এখন আমরা সিরিয়ার বিদ্রোহীদের সমর্থন দিচ্ছি এবং আমাদের কোনও ধারণা নেই যে এ লোকগুলো কারা।’
তিনি আশঙ্কা জানিয়েছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি আসাদ সরকারের ওপর আক্রমণ করে তবে যুক্তরাষ্ট্রকে শেষ পর্যন্ত রাশিয়ার সঙ্গে লড়াই করতে হবে।
ট্রেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্রিটিশ সরকার আশা করেছিল নির্বাচনে জয়ের পর ট্রাম্প এ ইস্যুতে তার সুর নরম করবেন। কিন্তু ওয়াল স্ট্রিটকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, তিনি রাশিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় রাখবেন।
যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র দফতরের কর্মকর্তারা বিশ্বাস করেন, ট্রাম্পের জন্য এ কাজটি করা ‘অবিশ্বাস্যরকমের কঠিন’। নিজেদের আগের অবস্থান ধরে রাখার পক্ষেই ব্রিটেন। ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দফতরের এক কর্মকর্তা টেলিগ্রাফকে বলেন, ‘ভবিষ্যত সিরিয়ায় আসাদের যে জায়গা হবে না সে ব্যাপারে আমাদের স্পষ্ট ধারণা রয়েছে। তার হাতে চার লাখ মানুষের রক্তের দাগ রয়েছে।’
পররাষ্ট্র দফতরের আরেক সূত্র আশা প্রকাশ করেছেন, পুতিনকে যখন সরাসরি মোকাবেলা করতে হবে তখন ট্রাম্প নিজের অবস্থান পরিবর্তনে বাধ্য হবেন।
ওই সূত্র বলেন, ‘এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই যে পুতিনকে তিনি এমন কোনও ব্যক্তি মনে করেন যার সঙ্গে কাজ করতে পারবেন। কিন্তু যখন তিনি বুঝতে পারবেন, পুতিন যুক্তিসঙ্গত ও নমনীয় নন তখন ট্রাম্প তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে পারেন। এর জন্য সময় লাগবে।’
কেবল রাশিয়া বা সিরিয়া ইস্যুতে নয়, ন্যাটোর ভবিষ্যত নিয়েও ব্রিটিশ সরকারের মাঝে প্রচণ্ড উদ্বেগ রয়েছে। ট্রাম্প ইঙ্গিত দিয়েছেন ন্যাটো থেকে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন প্রত্যাহার করে নিতে পারে। তার অভিযোগ, ইউরোপীয় সদস্য দেশগুলো তাদের বিল পরিশোধে ব্যর্থ হচ্ছে। সম্পর্কোন্নয়নের অংশ হিসেবে রাশিয়ার সীমান্ত থেকে বাহিনীকে উচ্ছেদ করে নিতে ন্যাটোকে উৎসাহিত করার জন্য পুতিনের পক্ষ থেকে ট্রাম্পকে আহ্বান জানানোর পর সে উদ্বেগ জোরালো হয়ে উঠেছে।
নরওয়ে সফরের সময় ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী মাইকেল ফ্যালনও এ ব্যাপারে সম্মত হয়েছিলেন যে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো যে খরচ যুগিয়ে থাকে তা ‘যথেষ্ট ভালো নয়’। ন্যাটোতে ইউরোপীয় সদস্যদের প্রতিরক্ষা ব্যয় জাতীয় আয়ের ১.৭ শতাংশ থেকে কমে ১.৪ শতাংশে নেমেছে। বেলজিয়াম, চেক রিপাবলিক, হাঙ্গেরি, ইতালি, লুক্সেমবার্গ, স্লোভেনিয়া ও স্পেন গত বছর এক শতাংশেরও কম খরচ দিয়েছে।
পুতিনের অফিসিয়্যাল মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ মার্কিন বার্তা সংস্থা এপিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘রাশিয়ার সীমান্তে ন্যাটোর সদস্যদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে ও ক্রমাগত নিকটবর্তী হচ্ছে।’
পেসকভ আরও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার আস্থা নির্মাণ পদ্ধতির অংশ হিসেবে সীমান্ত থেকে পুরোপুরি ন্যাটোর সামরিক বাহিনীকে প্রত্যাহার কিংবা কমিয়ে আনার মধ্য দিয়ে ট্রাম্প দুইদেশের সম্পর্কোন্নয়ন করতে পারেন’।
ব্রিটেনের ইউকেআইপি দলের নেতা নিজেল ফারেজ আশা প্রকাশ করে বলেন, ‘তিনি ব্রিটেন ও ট্রাম্পের মধ্যে ‘সেতু’ হিসেবে কাজ করতে পারবেন এবং ন্যাটোর ভবিষ্যত নিয়ে তৈরি হওয়া উদ্বেগগুলো প্রকাশ করতে পারবেন।’ ট্রাম্পের সঙ্গে থেরেসা মে’র যে প্রতিবন্ধকতা রয়েছে তা অবশ্যই সংশোধন করতে হবে বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।
পরে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইনার সার্কেলের সদস্যদের সঙ্গে নিউ ইয়র্কের ট্রাম্প টাওয়ারে মিলিত হন ফারেজ।
টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে বলা হয়, সোমবার পরিবর্তনশীল বিশ্বে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের গুরুত্বের ওপর জোর দিয়ে থেরেসা মে বক্তব্য রাকবেন। সেসময় মার্কিন নির্বাচনকে তিনি ব্রেক্সিটের সঙ্গে তুলনা করবেন বলে আভাস পাওয়া গেছে।
/এফইউ/
আপ - /এসএ/