মিয়ানমারের সহিংসতাকে ‘গণহত্যা’ বলতে নারাজ কফি আনান

কফি আনানমিয়ানমারে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যে সহিংসতা হচ্ছে তাকে ‘গণহত্যা’ হিসেবে আখ্যা দিতে রাজি ননরোহিঙ্গ জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি দাবি করেছেন, রাখাইন রাজ্যে মুসলিম ও বৌদ্ধ দুই সম্প্রদায়ের মধ্যেই আতঙ্ক বিরাজ করছে, এলাকায় উত্তেজনা চলছে, লড়াই চলছে-কিন্তু তাকে গণহত্যা আখ্যা দেওয়া যায় না। গত রবিবার মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক মিয়ানমারের সাম্প্রতিক সহিংসতার নিন্দা জানিয়ে অভিযোগ করেছিলেন, সেখানে গণহত্যা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, এ বছর অক্টোবর মাসের ৯ তারিখে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ এলাকায় সন্ত্রাসীদের সমন্বিত হামলায় ৯ পুলিশ সদস্য নিহত হওয়ার পর তার দায় চাপানো হয় রোহিঙ্গাদের ওপর। আর তখন থেকেই শুরু হয় সেনাবাহিনীর দমন প্রক্রিয়া। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের দাবি, এরপর থেকেই রাখাইন রাজ্যে 'ক্লিয়ারেন্স অপারেশন' চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। আর তা এমন কঠোর প্রক্রিয়ায় চালানো হচ্ছে যে সেখানে কোনও বহিরাগত এমনকি সংবাদমাধ্যমকেও প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। জাতিসংঘ এরইমধ্যে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে জাতিগতভাবে নির্মূল করার অভিযোগ এনেছে। তাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডেরও অভিযোগ তোলা হয়।
গত আগস্টে মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সু চি রাখাইন রাজ্যের অস্থিরতা খতিয়ে দেখতে গঠিত একটি কমিশনের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য কফি আনানকে অনুরোধ করেন। রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে তীব্র আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে দেশটির ক্ষমতাসীন দলের নেত্রী অং সান সু চি এই কমিশন গঠনে বাধ্য হন। ওই কমিশনের প্রধান হিসেবে সম্প্রতি দ্বিতীয়বারের মতো মিয়ানমার সফরে যান কফি আনান। রাখাইন রাজ্য পরিদর্শনের পর মঙ্গলবার (৬ ডিসেম্বর)বিবিসিকে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি সেখানে উত্তেজনা আছে, লড়াই আছে, কিন্তু কেউ কেউ এটাকে যেভাবে দেখছে আমি সেভাবে দেখতে চাই না।’

কফি আনান বলেন, ‘আপনি বুঝতে পারবেন সেখানে দুই সম্প্রদায়ের মানুষই ভীত। সেখানে আতঙ্ক আছে, অবিশ্বাস আছে। আতঙ্ক বেড়েছে কিন্তু তা দূর করতে আমাদেরকে একটি উপায় খুঁজে বের করতে হবে এবং সম্প্রদায়গুলোকে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য উৎসাহিত করতে হবে।’

তার মতে, গণহত্যা শব্দটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে পর্যবেক্ষকদেরকে অনেক অনেক সতর্ক হতে হবে।

মিয়ানমারের সেনাদের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের ওপর হত্যা, ধর্ষণ, গণধর্ষণের মতো বর্বরোচিত অপরাধের অভিযোগ উঠেছে। নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’ জানিয়েছে, প্রায় ৩০ হাজার মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে রোহিঙ্গাদের বহু গ্রাম। জাতিসংঘের হিসাবে, চলমান সহিংসতায় শুধু বাংলাদেশেই আশ্রয় নিয়েছেন কমপক্ষে ১০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী। এদিকে দেশটিতে অব্যাহত রোহিঙ্গা নির্যাতন ‘মানবতাবিরোধী অপরাধে’র শামিল বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা। সংস্থাটির এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সুপারিশ অনুযায়ী কাজ করতে মিয়ানমার সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।

দীর্ঘদিন ধরে সাম্প্রদায়িক তিক্ততা চলে আসছে রাখাইন বৌদ্ধ ও রাজ্যটিতে বসবাসকারী রোহিঙ্গা মুসলিমদের মধ্যে। দেশটিতে প্রায় এক মিলিয়ন রোহিঙ্গার নাগরিকত্ব অস্বীকার করা হয়, এমনকি দেশটির সরকার তাদের প্রাচীন নৃগোষ্ঠী হিসেবেও স্বীকৃতি দেয়নি। মিয়ানমারের জাতীয়তাবাদীরা জোর দিয়ে বলে আসছে, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসী। তারা রোহিঙ্গাদের ‘রোহিঙ্গা’ না বলে ‘বাঙালি’ বলে থাকে। তিক্ততার ফলে ২০১২ সালে রাখাইনে ভয়াবহ মুসলিমবিরোধী সহিংসতা সংঘটিত হয়। ১ লাখের ও বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে অবস্থান নিতে বাধ্য হয়। 

/এফইউ/