গণভোটে তুরস্কের বিভক্তি সামনে উঠে এসেছে: জার্মানি ও ফ্রান্স

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদ, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ান এবং জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলসংসদীয় পদ্ধতি থেকে প্রেসিডেন্ট শাসিত সরকার ব্যবস্থায় তুরস্কের রূপান্তর নিয়ে অনুষ্ঠিত গণভোটে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। ১৬ এপ্রিল ২০১৭ তারিখে অনুষ্ঠিত ওই গণভোটে প্রেসিডেন্ট শাসিত সরকার ব্যবস্থার প্রতি রায় দিয়েছেন ৫১ দশমিক ৪১ শতাংশ মানুষ। বিপরীতে এর বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থানের জানান দিয়েছেন ৪৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ ভোটার। এই ফলের মধ্য দিয়ে সামান্য ব্যবধানে জয় পেয়েছে প্রেসিডেন্ট শাসিত সরকারের পক্ষপাতী তুরস্কের ক্ষমতাসীন দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একেপি)। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, ক্ষমতা বেড়েছে দেশটির প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ান-এর। তবে এমন তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ গণভোটের মাধ্যমে তুরস্কের বিভক্তিই সামনে উঠে এসেছে বলে মনে করছে ইউরোপের দুই দেশ জার্মানি ও ফ্রান্স।

তুরস্কের গণভোট নিয়ে সোমবার এক বিবৃতি দিয়েছেন জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল এবং দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিগমার গ্যাব্রিয়েল। তারা বলেন, আধুনিক তুর্কি রাজনীতির সবচেয়ে বড় এই পটপরিবর্তনে এরদোয়ান সামান্য ব্যবধানে নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করেছেন। এই ফলের পর অস্ট্রিয়ার পক্ষ থেকে আবারও আহ্বান জানানো হয়েছে; ইউরোপীয় ইউনিয়নে তুরস্কের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে আলোচনা যেন স্থগিত করা হয়।

বিবৃতিতে বলা হয়, এই গণভোট দেখিয়েছে তুর্কি সমাজ কতটা গভীরভাবে বিভক্ত। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, তুর্কি নেতৃত্ব এবং ব্যক্তিগতভাবে দেশটির প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের প্রতি একটা বাড়তি দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। আমাদের প্রত্যাশা, আঙ্কারার কর্তৃপক্ষ তুর্কি সমাজের সবগুলো অংশের সঙ্গে সম্মানজনক আলোচনা চালিয়ে যাবে।

noname

জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিগমার গ্যাব্রিয়েল তুরস্কের ইউরোপীয় ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্তির আলোচনাকে একটা ভিন্ন রূপ দেওয়ার কথা বলেছেন। তার মতে, এ আলোচনা প্রতিবেশীসুলভ স্বীকৃতির আলোচনা হতে পারে। তার ভাষায়, ‘আওয়ার নেইবর’ ফরম্যাট নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। সিগমার গ্যাব্রিয়েল-এর এমন বক্তব্য মূলত ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর অবস্থানকেই প্রতিধ্বনিত করেছে।

আঙ্গেলা ম্যার্কেল এবং সিগমার গ্যাব্রিয়েল বলেন, তুরস্কের নিজস্ব সংবিধান বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে তুর্কি নাগরিকদের অধিকারের প্রতি জার্মান সরকার শ্রদ্ধাশীল। জার্মানিতেই তুর্কি বংশোদ্ভূত ৩০ লাখ মানুষ রয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকেও সব নাগরিকের অধিকারের প্রতি সম্মান জানানোর কথা বলা হয়েছে।

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদ বলেছেন, এটা তুর্কিদের ব্যাপার। তাদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপারে তারা নিজেরাই এককভাবে সিদ্ধান্ত নেবে। তবে গণভোটের যে ফল প্রকাশিত হয়েছে; তাতে দেখা গেছে দেশটিতে যে ব্যাপক সংস্কারের পরিকল্পনা করা হচ্ছে তার ব্যাপারে তুর্কি সমাজ বিভক্ত।

এদিকে রবিবার ইউরোপীয় কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গণভোটে সামান্য প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সরকার সমর্থকদের জয়ের ফলে তুরস্কের উচিত সাংবিধানিক পরিবর্তন নিয়ে একটা জাতীয় ঐকমত্যে পৌঁছানো।

তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিম বলেছেন, এই গণভোটে কেউ হারেনি, কিন্তু একটি পক্ষ জয়ী হয়েছে। আর সেই পক্ষ হচ্ছে তুরস্ক ও তুরস্কের মহৎ মানুষেরা।

noname

প্রধানমন্ত্রীর এমন দাবি অবশ্য মানতে রাজি নন বিরোধীরা। দেশটির প্রধান দুই বিরোধী দল গণভোটে তাদের পরাজয় মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। অবশ্য তুরস্কের গণতান্ত্রিক ইতিহাসের নির্বাচনগুলোর তুলনায় অনেকটাই সুষ্ঠু ছিল এই গণভোট। তবে দেশটির প্রধান বিরোধী দল দ্য রিপাবলিকান পিপল পার্টি (সিএইচপি) এই ফলের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তারা ৬০ শতাংশ ভোটের পুনঃগণনার দাবি জানিয়েছে। তুরস্কের বড় তিন শহর ইস্তাম্বুল, আঙ্কারা ও ইজমিরে ‘না’ ভোট পড়েছে বেশি।

ডেলমা ইনস্টিটিউটের একজন ফেলো সেলিম সাজাক বলেন, আজকের আগ পর্যন্ত তুর্কির সরকারবিরোধীরা মনে করত দেশটির নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। কিন্তু যাই হোক, এটা পটপরিবর্তনকারী ঘটনা।

এরদোয়ানের সমালোচকরা বলছেন, সংবিধানের এই সংশোধনীর ফলে এক ব্যক্তির শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে এবং ডি ফ্যাক্টো স্বৈরতন্ত্র কায়েম হবে। এরদোয়ানের সমর্থকদের যুক্তি, তুরস্কের অভ্যুত্থানের ইতিহাস, বিশেষ করে গত জুলাইয়ে ব্যর্থ অভ্যুত্থান চেষ্টা, অভ্যন্তরীণ বিরোধ ও জোট রাজনীতির ব্যর্থতার কারণে একজন শক্তিশালী নির্বাহী প্রয়োজন। নতুন এই ব্যবস্থা ২০১৯ সালের নির্বাচনের সময় থেকে কার্যকর হবে। এটি হবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর আধুনিক তুরস্কের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক পরিবর্তনের ঘটনা।

noname

ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের সিনিয়র ফেলো ওমর তাসপিনার বলছেন, ইস্তানবুলসহ তুরস্কের তিনটি বড় শহরে হ্যাঁ ভোট পরাজিত হয়েছে। অথচ একসময় ইস্তানবুলের মেয়র ছিলেন এরদোয়ান। তাসপিনার বলেন, গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত হচ্ছে ১৯৯৪ সালের পর প্রথমবারের মতো এরদোয়ান ইস্তানবুলে পরাজিত হয়েছেন। অনেক একেপি সমর্থকও তাকে ভোট দেননি। ভোটের ফলে দৃশ্যমান হয়, এরদোয়ানের বিরোধীরা একটি বিকল্প হয়ে সামনে আসতে পারে। তুর্কি গণতন্ত্রের জন্য বিরোধীদের মধ্যে বিভক্তি একটি ফোঁড়ার মতো। ফলে বিরোধীরা ঐক্যবদ্ধ হওয়ার দিকে এগুতে পারে। সূত্র: রয়টার্স, ওয়াশিংটন পোস্ট, বিবিসি।

/এমপি/